অপেক্ষার গল্প।। শহিদুল ইসলাম আকাশ
এই এলাকায় নতুন, মেয়েটিকে এর আগে এখানে কোথাও দেখিনি। আমাদের এলাকাটা এখনো অনেকটাই গ্রাম, এখানে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই প্রত্যেককে চিনি। নতুন কাউকে দেখলে আমরা তাই বুঝতে পারি, এ আগন্তুক।
বিশ-একুশের যুবতী মেয়েটি। প্রথম দিন যখন একটা দুই তলা ভবনের গেটের কাছে মেয়েটিকে দেখি, তখন বিকেল, কাজ সেরে বাইকে আমি ফিরছিলাম, চোখাচোখি হতেই মেয়েটি কেমন যেন হেসেছে। আমি চমকে উঠি। মেয়েটি এমন করে হাসবে কেন!
দু' দু'টা বাচ্চার বাবা আমি, বয়সও বাড়ছে, জুলফির নিচে চুলে পাক ধরেছে, ক্রমশই বাড়ছে পাকা চুলের সংখ্যা। আমাকে দেখে একটা যুবতী মেয়ের তাচ্ছিল্যের হাসি হাসা যায়, কিন্তু ওভাবে হাসবে কেন! যে হাসির অন্য কোনো অর্থ আছে বলে মনে হয়! ওসব প্রেমময় হাসি-টাসির পর্ব তো চুকে গেছে কবেই।
পরের দিন আবার মেয়েটিকে দেখি। দেখি সেদিনও একা একাই দাঁড়িয়ে আছে। সে কি আমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে, সে জানে আজও এই পথেই ফিরবো আমি! পরক্ষণেই ধিক্কার দিই নিজেকে, দুই বাচ্চার বাবা আমি, একটা যুবতীকে নিয়ে এসব কী ভাবছি, ছি!
এরপরও রোজ বিকেলেই মেয়েটিকে দেখতে থাকি, কোনোদিন পাশের দোকান থেকে কিছু একটা কিনছে তো গেটের বাইরে রাস্তায় পায়চারি করছে। কোনো কোনোদিন দেখি গেটের ভেতর আপনমনে হাঁটছে, খোলা গেটের ফাঁক দিয়ে চলতি বাইকে আড়চোখে একপলক দেখতে ভুলি না। মেয়েটি একা একা রোজ এইসময়ে বাইরেই থাকবে কেন! কোনো মতলব-টতলব নেই তো!
তারপর হঠাৎ একদিন, মেয়েটিকে দেখলাম না আর৷ তারপর দিনও না, তারপরের দিনও না। মেয়েটির হলো কী! মাঝেমধ্যে পাশের দোকানটা থেকে মেয়েটিকে কিছু কিনতে দেখেছি, ইচ্ছে হলো, দোকানদারের কাছে মেয়েটির কথা জানতে চাই। কিন্তু না, সে ইচ্ছে সংবরণ করলাম। মেয়েটি কে, কেন রোজ এইখানে তাকে দেখি, কেনইবা গত তিনদিন তাকে দেখছি না আর, তাতে আমারইবা কী! আমি এমন করে ভাবতে লাগলাম।
কিন্তু চতুর্থদিনের দিন মেয়েটিকে আবারও দেখতে পেলাম৷ কিন্তু একি, একটা যুবক এসে গেটের পাশে দাঁড়াতেই, অপেক্ষামান মেয়েটি যুবকটির হাত ধরলো, যুবকটিও তার একটা হাত মেয়েটির পিঠে রাখলো, তারপর দু'জনেই গেটের ভেতর ঢুকে গেলো। কে এই যুবক! মেয়েটি কোনো খারাপ মেয়ে নয় তো! আজকাল এমন বাড়িতে ভাড়া থেকে নানা অনৈতিক কাজের কথা শুনেছি। এমনই কিছু কি! তবে কি এই মেয়েটিও...।
অবশেষে একদিন এই সকল রহস্যের সমাধানও হলো। সেদিন একটা কাজে এই বাড়ির মালিকের সাথে আমার দেখা করতে হলো। বাড়ির জমির সীমানাবিরোধ সংক্রান্ত বিষয়৷ পাশের জমির মালিকের দাবি, এই বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের মধ্যে তার তিন ফুট জমি আছে।
সেই বিরোধটা নিয়ে বাড়িটির মালিকের সাথে কথা বলতে গিয়ে, সেই মেয়েটির প্রসঙ্গ তুললাম, মেয়েটি কে তা জানতে চাইলাম। বাড়ির মালিক এমন হাহাহাহা করে হাসতে শুরু করলেন, যেন আমি কঠিন কোনো কৌতুকের কথা বলেছি।
তিনি বললেন, 'গেলো মাসে তাঁর বাড়ির একটা ফ্ল্যাটে ভাড়ায় উঠেছে তারা। পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছে দু'জনে। স্বামী এখানেই কোথাও একটা চাকরি নিয়েছে। প্রতিদিন বিকেলে স্বামী চাকরি থেকে বাসায় না-ফেরা পর্যন্ত মেয়েটি বাইরে নয়তো গেটের ভেতর অপেক্ষায় থাকে রোজ। মাঝে তিন দিন ওর স্বামী ছেলেটি চাকরির প্রয়োজনে কোথাও গিয়েছিলো, এই তিন দিন একবারের জন্যও মেয়েটি ঘর থেকে বের হয়নি। এই যুগেও স্বামীর জন্য এমন টান সত্যিই দেখা যায় না।' এরপর আবারও হাসতে লাগলেন বাড়ির বৃদ্ধ মালিক। সেদিন যে যুবকের হাত ধরতে দেখেছি, তাহলে সেই যুবকটিই মেয়েটির স্বামী!
এরমধ্যে মেয়েটিও হঠাৎ আমাদের আলাপের মধ্যে এসে গেলো। বাড়ির ভাড়াটা দিতে এসেছে। আমাকে দেখেই সেই প্রথম দিনের মতো হেসে উঠলো। এরপর আমাকে সে যা বললো, তা শুনে আমার ধারণাই পাল্টে গেলো। সে বললো, 'আপনি প্রতিদিন এই পথে যান। প্রথম দিন আপনাকে দেখে আমি অবাক হয়েছি। আপনার বাইকটাও আমার হাসবেন্ডের বাইকের মতো, তাছাড়া দূর থেকে দেখতেও আপনাকে ঠিক ওর মতোই মনে হচ্ছিলো। আপনি সামনে আসতেই লজ্জায় পড়ে গেলাম। আপনি সেদিন কী মনে করেছেন কে জানে!'
শুধু কি কী মনে করেছি আমি! প্রতিদিন মেয়েটিকে দেখে কতো কী কী-ই না মনে করেছি, কতো সব আজেবাজে ও অসভ্য ভাবনা। এখন এসব ভাবতেই, আমারই লজ্জা লাগছে।
সত্যিই, আমাদের চেনা কিছুর সাথে না-মিললে আমরা মানুষকে কতো রকমের ভুলই না বুঝি, নিজেদের মতো কতোরকম অর্থই-না বানিয়ে নিই! বাস্তবের সাথে যার কোনো যোগ থাকে না। কিছুতেই না।
আজকের পরও আমার ফিরবার পথে প্রতিদিন নিশ্চয় মেয়েটিকে দেখবো আমি। একটি অবুঝ যুবতীর তার প্রিয়তম পুরুষটির জন্য অপেক্ষা। যে অপেক্ষার চেয়ে মানবজীবনে সুন্দর ও মধুরতম অপেক্ষা আর একটিও নেই।
Comments
Post a Comment