তারপর একদিন বৃষ্টি নামবে
শহিদুল ইসলাম আকাশ
তারপর একদিন তোমার সাথে দেখা হবে। তোমার খোলা চুল বাউল বাতাসে উড়বে। মাঝেমাঝেই উড়ে এসে আছড়ে পড়বে তোমার চোখে, মুখেও। তুমি হাত দিয়ে বিস্রস্ত চুলগুলো সরিয়ে রাখবে কানের পাশে। অশত্থ পাতার মতো থরোথরো কাঁপবে তোমার ঠোঁট, তুমি নীরব থাকবে তবু।
আমরা পাশাপাশি বসে থাকবো, অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলবো না। এক পর্যায়ে নিরবতা ভাঙবো আমিই, বলবো, 'জানো, একবার এতোটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম আমি যে, কাউকে চিনতে পর্যন্ত পারছিলাম না--মা-বাবা বোন, কাউকেই না। পরে মার মুখে শুনেছিলাম, সেই সময়ে আলঝেইমার্সের রোগী যেন আমি, তখনো নাকি থেমে থেমে এই একটি নামই জপছিলাম শুধু--তোমারই নাম--জ্যোতি জ্যোতি জ্যোতি...।'
একটু থেমে আবার বলবো, 'মৃত্যুর পরে কী থাকে জানি না। কেউ বলেন, অনন্ত নক্ষত্রবীথির কথা, কেউ কেউ বলেন মৃত্যুর পরে শুধুই নিদারুণ শূন্যতা। কিন্তু মার মুখে সেদিনের সেই বিবরণ শুনে আমার মনে হলো, যা-ই থাকুক-না কেন মৃত্যুর পরে, তখনো আমার নিস্তেজ দেহের সবটুকু জুড়ে থাকবে এক তুমিই। এই জীবনের মতো সেই মরণেও।'
আমার কথা শুনে তোমার চোখ ছলছল করে উঠবে। তবু কী এক আশ্চর্য ক্ষমতায় বুকের গহীনের বাঁধভাঙা সেই কান্না আটকে রাখবে তুমি! অনেক কষ্টে ঠোঁটের কোণায় ফুটাতে চাইবে স্মিত হাসি, তারপর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলবে, 'কেউ কাউকে এতো ভালোবাসে, বাসতে পারে!'
উত্তরে আমি বলবো, 'সবাই পারে না, কেউ কেউ পারে।'
এই পর্যায়ে এসে তুমি আমার চোখে চোখ রেখে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকবে। আমার চোখের গভীরে ডুব দিয়ে দেখতে চাইবে হারানো দিন, পুরোনো স্মৃতি। মন বাড়িয়ে ছুঁয়েও দেখবে হয়তো। দীর্ঘশ্বাসে বুক ভারী করে হয়ে উঠবে আমার--যায় যে দিন, ফিরে কেন আসে না আর! কেন...! তবে কি মিথ্যে এই যে, রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে!
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসবো আমি, তুমিও। সেই প্রথম চোখে চোখ রাখা, হাতে হাত; সেই যে প্রথম ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়েছি অমৃত অমরত্ব! বলবো সব, পরস্পরকে। কতো নির্ঘুম সারারাতি আমরা ভিজেছি জোছনার মোহন বৃষ্টিতে, কতো কতো শীতরাতে আমার বুকে মুখ গুঁজে ভালো লাগায় তুমি কেঁপে কেঁপে উঠেছো লজ্জাবতী লতার মতো, পরম সুখে--সেই সব কথাও বলবো আমরা। সেই যে কেমন অন্ধকারকে সাজিয়েছি আয়োজন করে, নীল জোনাকি উড়েছিলো আমাদের বুকের মধ্যে--বাদ যাবে না কিছুই। সময় কতো দ্রুতই না বদলে যায়!
এতো এতো স্মৃতি রোমন্থনে, স্মৃতির গন্ধে মনে মনে কেঁদে উঠবো আমি, হয়তো তুমিও। কিন্তু আমাদের সে কান্না আমরা কেউ-ই দেখবো না। দেখাবোও না--কেউ-ই, কাউকেই।
সোনালী ডানার একটা চিল আকাশময় উড়ে বেড়াবে, তুমি আকাশের দিকে মুখ তুলে, সেই চিলটার উড়াউড়ি দেখতে দেখতে জানতে চাইবে, 'মানুষের জীবনটা এমন কেন বলতো পারো? যেখানে সে আজন্ম যেতে চায়, সেখানে না-গিয়ে অন্য কোনো অনিচ্ছুক গন্তব্যে পৌঁছে থিতু হয়ে বসে পড়তে হয়! কেন এমন হয়!'
আমি হেসে উঠবো, বলবো, 'তোমার আজকের গন্তব্য তো তোমার অনিচ্ছুক ছিলো না। ছিলো কি?'
হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলবে তুমি, বলবে, 'এখন তোমার শরীর কেমন?'
সেই উত্তর না-দিয়ে আমিও ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে আনবো--সেই যে একবার আমরা পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কাজী অফিস পর্যন্ত গিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার পরিবারের কথা ভেবে হঠাৎ তুমি সিদ্ধান্তটাই পাল্টে ফেললে! বিয়ে বাদ দিয়ে কাজী অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে গেছো সেদিন তুমি। সেই দিনের সেই কথা আমি আবার ফিরিয়ে আনবো।
তুমি নিরব হয়ে যাবে আবার হঠাৎ। কিছুক্ষণ পর বলবে, 'থাক না ওসব আজ। জীবন আমাদের হাতের মুঠোয় ছিলো না। বোধহয় থাকেও না, কারোরই।'
বাতাসে উড়ে আসা তোমার চুল, অনধিকার জেনেও আমি হাত বাড়িয়ে তোমার কানের পাশে সরিয়ে দেবো। তুমিও বাঁধা দেবে না। সরিয়ে দিতে দিতে বলবো, 'আমার শরীর এখন কেমন জানতে চেয়েছো একটু আগে। শরীরটা একটুও ভালো নেই জ্যোতি, আর মাত্র ক'টা দিনই হয়তো, তারপরই চলে যাবো, যেতে হবে সেই গন্তব্যে__যে গন্তব্যের শেষে হাতে জোনাকির আলোটুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না।'
তুমি বিষণ্ণ হয়ে যাবে। বিস্ময়ে জানতে চাইবে, 'এ কী বলছো!'
আমার অসুস্থতার কথা তোমারও জানা। তবু বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে তোমার, সে অসুস্থতা যে এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে শেষতক। জবাবে আমি বলবো, 'কিন্তু বিশ্বাস করো জ্যোতি, মরে যেতে ইচ্ছে করে না আমার একটুও। কারো ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় কিছুই এসে-যায় না মৃত্যুর কাছে যদিও, তবু। আমার খুব ইচ্ছে করে আমি বেঁচে থাকি অনন্তকাল আর শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।'
হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। খোলা আকাশের নিচে আমরা দুই মানব-মানবী ভিজতে থাকবো। আমাকে অবাক করে দিয়ে হু হু শব্দে কেঁদে উঠবে তুমি। অঝর বৃষ্টিতে সেই কান্না কী যে ভীষণ ছোঁয়াচে হবে!
তারপর একদিন তোমার সাথে দেখা হবে। তোমার খোলা চুল বাউল বাতাসে উড়বে। মাঝেমাঝেই উড়ে এসে আছড়ে পড়বে তোমার চোখে, মুখেও। তুমি হাত দিয়ে বিস্রস্ত চুলগুলো সরিয়ে রাখবে কানের পাশে। অশত্থ পাতার মতো থরোথরো কাঁপবে তোমার ঠোঁট, তুমি নীরব থাকবে তবু।
আমরা পাশাপাশি বসে থাকবো, অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলবো না। এক পর্যায়ে নিরবতা ভাঙবো আমিই, বলবো, 'জানো, একবার এতোটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম আমি যে, কাউকে চিনতে পর্যন্ত পারছিলাম না--মা-বাবা বোন, কাউকেই না। পরে মার মুখে শুনেছিলাম, সেই সময়ে আলঝেইমার্সের রোগী যেন আমি, তখনো নাকি থেমে থেমে এই একটি নামই জপছিলাম শুধু--তোমারই নাম--জ্যোতি জ্যোতি জ্যোতি...।'
একটু থেমে আবার বলবো, 'মৃত্যুর পরে কী থাকে জানি না। কেউ বলেন, অনন্ত নক্ষত্রবীথির কথা, কেউ কেউ বলেন মৃত্যুর পরে শুধুই নিদারুণ শূন্যতা। কিন্তু মার মুখে সেদিনের সেই বিবরণ শুনে আমার মনে হলো, যা-ই থাকুক-না কেন মৃত্যুর পরে, তখনো আমার নিস্তেজ দেহের সবটুকু জুড়ে থাকবে এক তুমিই। এই জীবনের মতো সেই মরণেও।'
আমার কথা শুনে তোমার চোখ ছলছল করে উঠবে। তবু কী এক আশ্চর্য ক্ষমতায় বুকের গহীনের বাঁধভাঙা সেই কান্না আটকে রাখবে তুমি! অনেক কষ্টে ঠোঁটের কোণায় ফুটাতে চাইবে স্মিত হাসি, তারপর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলবে, 'কেউ কাউকে এতো ভালোবাসে, বাসতে পারে!'
উত্তরে আমি বলবো, 'সবাই পারে না, কেউ কেউ পারে।'
এই পর্যায়ে এসে তুমি আমার চোখে চোখ রেখে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকবে। আমার চোখের গভীরে ডুব দিয়ে দেখতে চাইবে হারানো দিন, পুরোনো স্মৃতি। মন বাড়িয়ে ছুঁয়েও দেখবে হয়তো। দীর্ঘশ্বাসে বুক ভারী করে হয়ে উঠবে আমার--যায় যে দিন, ফিরে কেন আসে না আর! কেন...! তবে কি মিথ্যে এই যে, রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে!
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসবো আমি, তুমিও। সেই প্রথম চোখে চোখ রাখা, হাতে হাত; সেই যে প্রথম ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়েছি অমৃত অমরত্ব! বলবো সব, পরস্পরকে। কতো নির্ঘুম সারারাতি আমরা ভিজেছি জোছনার মোহন বৃষ্টিতে, কতো কতো শীতরাতে আমার বুকে মুখ গুঁজে ভালো লাগায় তুমি কেঁপে কেঁপে উঠেছো লজ্জাবতী লতার মতো, পরম সুখে--সেই সব কথাও বলবো আমরা। সেই যে কেমন অন্ধকারকে সাজিয়েছি আয়োজন করে, নীল জোনাকি উড়েছিলো আমাদের বুকের মধ্যে--বাদ যাবে না কিছুই। সময় কতো দ্রুতই না বদলে যায়!
এতো এতো স্মৃতি রোমন্থনে, স্মৃতির গন্ধে মনে মনে কেঁদে উঠবো আমি, হয়তো তুমিও। কিন্তু আমাদের সে কান্না আমরা কেউ-ই দেখবো না। দেখাবোও না--কেউ-ই, কাউকেই।
সোনালী ডানার একটা চিল আকাশময় উড়ে বেড়াবে, তুমি আকাশের দিকে মুখ তুলে, সেই চিলটার উড়াউড়ি দেখতে দেখতে জানতে চাইবে, 'মানুষের জীবনটা এমন কেন বলতো পারো? যেখানে সে আজন্ম যেতে চায়, সেখানে না-গিয়ে অন্য কোনো অনিচ্ছুক গন্তব্যে পৌঁছে থিতু হয়ে বসে পড়তে হয়! কেন এমন হয়!'
আমি হেসে উঠবো, বলবো, 'তোমার আজকের গন্তব্য তো তোমার অনিচ্ছুক ছিলো না। ছিলো কি?'
হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলবে তুমি, বলবে, 'এখন তোমার শরীর কেমন?'
সেই উত্তর না-দিয়ে আমিও ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে আনবো--সেই যে একবার আমরা পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কাজী অফিস পর্যন্ত গিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার পরিবারের কথা ভেবে হঠাৎ তুমি সিদ্ধান্তটাই পাল্টে ফেললে! বিয়ে বাদ দিয়ে কাজী অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে গেছো সেদিন তুমি। সেই দিনের সেই কথা আমি আবার ফিরিয়ে আনবো।
তুমি নিরব হয়ে যাবে আবার হঠাৎ। কিছুক্ষণ পর বলবে, 'থাক না ওসব আজ। জীবন আমাদের হাতের মুঠোয় ছিলো না। বোধহয় থাকেও না, কারোরই।'
বাতাসে উড়ে আসা তোমার চুল, অনধিকার জেনেও আমি হাত বাড়িয়ে তোমার কানের পাশে সরিয়ে দেবো। তুমিও বাঁধা দেবে না। সরিয়ে দিতে দিতে বলবো, 'আমার শরীর এখন কেমন জানতে চেয়েছো একটু আগে। শরীরটা একটুও ভালো নেই জ্যোতি, আর মাত্র ক'টা দিনই হয়তো, তারপরই চলে যাবো, যেতে হবে সেই গন্তব্যে__যে গন্তব্যের শেষে হাতে জোনাকির আলোটুকুও আর অবশিষ্ট থাকে না।'
তুমি বিষণ্ণ হয়ে যাবে। বিস্ময়ে জানতে চাইবে, 'এ কী বলছো!'
আমার অসুস্থতার কথা তোমারও জানা। তবু বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে তোমার, সে অসুস্থতা যে এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে শেষতক। জবাবে আমি বলবো, 'কিন্তু বিশ্বাস করো জ্যোতি, মরে যেতে ইচ্ছে করে না আমার একটুও। কারো ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় কিছুই এসে-যায় না মৃত্যুর কাছে যদিও, তবু। আমার খুব ইচ্ছে করে আমি বেঁচে থাকি অনন্তকাল আর শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।'
হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। খোলা আকাশের নিচে আমরা দুই মানব-মানবী ভিজতে থাকবো। আমাকে অবাক করে দিয়ে হু হু শব্দে কেঁদে উঠবে তুমি। অঝর বৃষ্টিতে সেই কান্না কী যে ভীষণ ছোঁয়াচে হবে!
Comments
Post a Comment