চোখের জল

শহিদুল ইসলাম আকাশ

'ঘরে অসুস্থ বাবা-মা, ছোট দু'টি বোন। একটা দোকানে কর্মচারীর চাকরি করি। আমার একজনের আয়ে চলে পুরো সংসার__সংসারের খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে, অসুস্থ বাবা-মার চিকিৎসা, ছোট বোন দু'টির পড়ালেখা__সব আমার একার সামান্য আয়েই সামলাতে হয়। এমন দুরবস্থার মধ্যে একটা অপরিণামদর্শী কাজ করে বসলাম।'

পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স মানুষটার। চোখে পুরো লেন্সের চশমা। এক নাগাড়ে তিনি যখন কথাগুলো বলছিলেন, তাঁর চেহারায় তখন গাঢ় বিষাদের ছায়া।

বললাম, 'কাজটা কী?'

তিনি বললেন, 'আমার এক মামা, পরীর মতো সুন্দর সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ এক মেয়ের সাথে, আমার বিয়ে ঠিক করে বসলেন। সেই মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেললাম।'

বললাম, 'এরকম পরিস্থিতিতে বিয়ে করা আসলেই অপরিণামদর্শীই।'

বললেন, 'অভাবের সংসারে টানাপড়েন লেগেই থাকে। অসুস্থ বাবা-মার সেবাশুশ্রূষা, ছোট দু'টি বোনের দেখভাল, আমার দিকে খেয়াল রাখা__এইটুকু একটা বাচ্চামেয়ে, সব কাজ অনেকটা একা হাতেই সামলাতো সে।'

ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে বসে অপরিচিত মানুষটির সাথে কথা বলতে বলতে, তাঁর পরনের উজ্জ্বল পোশাকআশাক দেখে আমার মনে হচ্ছিলো না খুব একটা দরিদ্র তিনি। তা বললামও, 'এখন তো আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে, আপনি খুব একটা দরিদ্র।'

স্মিত হাসি হেসে তিনি বললেন, 'ঠিকই ধরেছেন, সেই অর্থে এখন আর কোনো অভাব নেই আমার।'

বললাম, 'এখন তো আর আপনার বা আপনাদের তেমন কোনো কষ্টও নেই, না?'

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। থামলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, 'একটা সময় চাকরি ছেড়ে নিজেই ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করলাম। কপাল ফিরলো, দিনেদিনে ব্যবসাটা বেশ জমে উঠতে লাগলো। এরই মধ্যে বাবা মারা গেলেন, মাস দুয়ের মাথায় মা-ও। এর কিছুদিন পর ছোট বোন দু'টাও পাত্রস্ত করলাম।'

বললাম, 'তারপর?'

'সুখের সময়টা যখন এলো, তখন সুখের সেই মঙ্গলময় বাহু আমাদের স্পর্শ করলো না। আমার স্ত্রীও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলো। এই ডাক্তার সেই ডাক্তার, এই টেস্ট সেই টেস্টের পরে ধরা পড়লো দুরারোগ্য রোগ__ক্যান্সার। ডাক্তার জানালেন, এখন লাস্ট স্টেজ, কিছুই করার নেই।' বললেন তিনি।

বললাম, 'তিনি কি এখন বেঁচে নেই?'

মানুষটার চোখ অশ্রুসিক্ত। কথা বলতে গিয়ে গলায় আটকে যাচ্ছিলো, বললেন, 'হু...হুম। ক্যান্সার ধরা পড়ার তিন মাসের মধ্যে সে মারা যায়।'

এই পর্যায়ে ট্রেন এসে যায়, লাগেজ নিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠতে গিয়ে আরেকবার বসলেন তিনি, বললেন, 'আমার স্ত্রীকে এই জীবনে অনেক দুঃখদুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। জীবীকার তাগিদে আমাকেও এতো ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে, একবারের জন্যও তাকে 'ভালোবাসি' শব্দটা বলা হয়নি। কী জানি পরের জন্ম বলে কিছু আছে কিনা, থাকলে...!'

বলেই তিনি বিদায় নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে-থাকা ট্রেনে উঠতে পা বাড়ালেন। পিছু থেকে বললাম, 'যদি থাকে...?'

তিনি থমকে দাঁড়ালেন পুনর্বার, বললেন, 'যদি থাকে, তাহলে সে জন্মে আমি এই একটি কথাই ঘুরেফিরে বলবো তাকে__'আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি, পারুল!"

বলতে বলতে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন তিনি, দু'টি চোখে বৃষ্টির ফোঁটার মতো জল বেয়ে পড়তে লাগলো। দেখে বড় মায়া লাগলো আমার। চোখের জল বড়-বেশি ছোঁয়াচে হয়।   

Comments