ছোঁয়া

শহিদুল ইসলাম আকাশ

গল্পবাজ মানুষ তিনি। দেখা হলেই নানান গল্প জুড়ে বসেন। গল্প বলার ধরণও বলার মতো, সামনে বসে যেন কোনো অসাধারণ গল্পের বই পাতার পর পাতা উল্টে পড়ে শোনাচ্ছেন। সবসময় হাসিখুশিতে প্রাণবন্ত থাকেন। বয়সে আমার দ্বিগুণ, তবু কথা বলার সময় আমার সাথে এমনভাবে বলেন, তাঁর সমবয়সী কোনো বন্ধুর মতোই। সিগারেটও সেধে বসেন কখনোকখনো। 

গত সপ্তাহে তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। তারও এক সপ্তাহ আগে আমার বাসায় এসে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। ফোনেও বলেছেন অসংখ্যবার, বিয়েতে আমাকে যেতেই হবে। আমি কথাও দিয়েছিলাম, যাবো। কিন্তু কথা রাখা হয়ে উঠেনি। এতো ব্যস্ততায় দিন যায় আমার, কোথায় যেতে কোথায় চলে যাই, ঠিক থাকে না। বিয়েতে যেতে পারিনি বলে তিনি আমার উপর রাগ করেছেন, তা বুঝতে পারছি। রাগ না করলে এই ক'দিনে তিনি অনেকবার আমাকে ফোন দিতেন। কিন্তু দেননি। দেখাটেখাও হয়নি বা করেননি।

সকাল থেকে নানা কাজে দম ফেলার সময় না-পাওয়ার মতোই ব্যস্ত ছিলাম যথারীতি আজকেও। কাজে কাজে রাত হয়ে গেলো। অনেক রাত। বাসায় ফেরার পথে তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে আসছিলাম। তাঁর বাড়ির সামনে এসে থামলাম। সারাদিনের ক্লান্তি শরীরে, তবু ভাবলাম একবার তাঁর সাথে দেখা করে যাই, তাঁর মেয়ের বিয়েতে উপস্থিত হতে পারিনি, ক্ষমা চেয়ে যাই। এখনো জেগে আছেন হয়তো, এতো রাতেও বাড়ির গেট খোলা। সচরাচর এমন সময় গেট বন্ধই দেখি।

আমি মোটরবাইকটা বাড়ির সামনে রেখে, দরজায় কড়া নাড়লাম। তাঁর স্ত্রী এসে দরজা খুলে দিলেন। আমি তাঁর স্ত্রীর কাছে তাঁর কথা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, তাঁর স্বামী জেগেই আছেন। মেয়ের রুমে আছেন। বললেন, আমার যেতে কোনো সমস্যা নেই। 

আমি ভেতরের দিকে এগোলাম। তাঁর মেয়ের রুমে ঢুকলাম। দেখি তিনি ফুটপাতের দোকানের মতো ঘরের ফ্লোরে নানানরকম অনেককিছু সাজিয়ে বসে আছেন আর একদৃষ্টে সেইসবের দিকে তাকিয়ে আছেন। দেখি, ফ্লোরে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে নানা রঙের পোশাক, সেই সাথে নেইল পালিশ, লিপস্টিকের মতো অন্য অনেক প্রসাধনী। হরেক রঙের পুতুল, ফুলদানি; আছে চুলের রিবন থেকে পায়ের নূপুরও। আছে ল্যাপটপ, সিডি ক্যাসেট, পেনড্রাইভ, বই। আছে একটি মেয়ের অসংখ্য ছবিও__শৈশবের, কৈশোরের, যৌবনের__নানান বয়সের। ছবির এই মেয়েটিই কি তাঁর মেয়ে?

তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। তবু তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি পেছন থেকে ডাকলাম। তিনি আমার দিকে ফিরলেন না। ফ্লোরে ছড়িয়েছটিয়ে রাখা নানানপ্রকার জিনিসপত্রের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন, 'মেয়েটার বিয়ে হলো এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। এই যে এতো কিছু সামনে নিয়ে বসে আছি, এইসবের আর কিছুরই আমার মেয়ের প্রয়োজন নেই। অথচ এর প্রত্যেকটা কিছুর সাথেই জড়িয়ে আছে তার হাতের এবং মনের ছোঁয়া।'

বলেই, আমার দিকে ফিরলেন তিনি। দেখি, তাঁর দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। আমার পেছনে দাঁড়ানো তাঁর স্ত্রীর দিকেও তাকালাম এক পলক, শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘনঘন চোখের পাতা মুছছেন তিনিও__চোখের জল আড়াল করার সে কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা তাঁর!   

Comments