জীবনের রঙ

শহিদুল ইসলাম আকাশ

নীলক্ষেতের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। যাবো ইসলামবাগ। রিকশা খুঁজছি। এমন সময় দৃশ্যটা চোখে পড়লো।

পাশের ফুটপাতে একজোড়া তরুণ-তরুণী নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। তরুণী উত্তেজিত। কিছু একটা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে বুঝতে পারছি। আমি রিকশা খুঁজা বাদ দিয়ে তাদের কথা শুনতে চেষ্টা করলাম।

তরুণী বলছে, 'আজকের পর থেকে তুমি আর আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে না বলে দিচ্ছি।'

তরুণের অসহায় আকুতি, 'প্লিজ তুমি আমার কথা বুঝতে তো চাইবে নাকি?' 

তরুণী বলছে, 'তুমি তোমার বুঝা না-বুঝা নিয়ে থাকো। আমি গেলাম।'

তরুণ আকুতিভরা কণ্ঠে বললো, 'প্লিজ যেও না। আমার কথা তো অন্তত শুনো আগে।'

তরুণী শুনলো না আর কিছুই। হনহন করে হেঁটে ফুটপাতের বাইরে রাস্তায় নেমে রিকশা খুঁজতে লাগলো। যে রিকশাই দেখে হাত দিয়ে থামায় সে, বলে, 'কাকরাইল যাবেন?' একে-একে সব রিকশাই যাবে না বলে জানায়। তরুণীর চোখেমুখে চরম বিরক্তি।

ফুটপাতে তখনো তরুণটি অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তরুণীটির দিকে। আমি এবার এগিয়ে গিয়ে তরুণের পাশে দাঁড়ালাম। দেখি, তার দু'টি চোখ অশ্রুসজল। তাকে হাসাতে চেষ্টা করে বললাম, 'কী ভাই পাখি উড়াল দিছে নাকি? ফুরুত!' 

একজন অপরিচিত মানুষের এমন কথায় সে কিছুটা হতচকিত হলো। বললাম, 'তা আপনি এমন কী বলতে চেয়েছিলেন মেয়েটিকে, মেয়েটি তা শুনতেই চাইলো না?' আমার কথায় অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো সে, কিছুই বললো না। বললাম, 'মেয়েগুলো এমনই অভিমানী হয়! এ লিঙ্গগত ব্যাপার ভাই, লিঙ্গগত। আবার এ কথাও সত্যি যে, অভিমানের মতো তাদের ভালোবাসাও তীব্র হয়।' তারপর বললাম, 'মেয়েটিকে আপনার কাছে ফেরাতে পারি কিনা চেষ্টা করে দেখি।' 

আমার শেষের কথাটি শুনে তরুণের চোখের জমাটবাঁধা অশ্রু এখনই যেন বেরিয়ে যাবার উপক্রম হলো। যেন বলতে চাইছে, 'প্লিজ ভাই, এখনই করুন না, প্লিজ।'

তরুণী তখনো রিকশা পায়নি। একটার পর একটা রিকশাকে তখনো সে বলেই যাচ্ছে, 'কাকরাইল যাবেন, কাকরাইল?'

আমি তরুণীর দিকে এগোলাম এবার। কাছে গিয়ে বললাম, 'আপনি বড় সৌভাগ্যবতী। একটা ছেলে আপনার জন্য রীতিমতো কাঁদছে। এই পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সৌভাগ্যেরই ব্যাপার।' 

আমার কথা শুনে তরুণী এমনভাবে আমার দিকে তাকালো, যেন তাদের নিজেদের ব্যাপারে নাক গলিয়ে আমি বড় অন্যায় করেছি। আমি তা আমলে নিলাম না। স্বাভাবিকভাবেই বললাম, 'এখনই ছেলেটার কাছে যান। গিয়ে তাকে বলুন, 'এই এখনই আমার হাতটা ধরো তো। তোমার হাত ধরে কিছুক্ষণ খুব হাঁটতে ইচ্ছে করছে আমার।' প্লিজ যান না! দেরি করছেন কেন!'

এবার তরুণীর চূড়ান্ত অবাক হবার পালা। হলোও তাই। সে এখন আর রিকশা খুঁজছে না। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণের দিকে তাকিয়ে রইলো। অদূরে দাঁড়িয়ে তরুণও আমার পাগলামী দেখছে। এখন তরুণের চোখেও বিষাদ নেই, তার চোখেও গাঢ় বিস্ময়। যেন তারও দেখার ইচ্ছে, এরপর কী হয়!

আমাকে অবাক করে তরুণী মেয়েটি তরুণ ছেলেটির দিকে এগোতে লাগলো। আমি আমার গন্তব্যের একটা রিকশা পেয়ে তাতে উঠে গেলাম। চলন্ত রিকশা থেকে একবার তাদের দিকে তাকালাম। তরুণী এখন তরুণের খুব কাছে দাঁড়িয়ে। রিকশা চলছে, একটু পরই আমি মোড় পেরিয়ে চলে আসলাম। 

আমি জানি না, সেই তরুণী কাছে গিয়ে তরুণকে তার হাত ধরতে বলেছে কিনা। মনে বলে, বলেছে। তরুণী যখন বলবে, 'আমার হাতটা একটু ধরবে? তোমার হাত ধরে আমার কিছুক্ষণ হাঁটতে ইচ্ছে করছে'-- তখন তরুণ হেসে বলবে, 'শুধু কিছুক্ষণ না; হাজার জন্ম ও জন্মান্তরে আমি শুধু তোমারই হাত ধরে হাঁটতে চাই।' 

তারা কি এই মুহূর্তে হাতে হাত ধরে হাঁটছে? 

রিকশায় করে যেতে যেতে দেখি, তখন হলুদ রঙা বিকেল নেমেছে ঠাসবুনোটের শহরেও। যানজট, অবিরাম গাড়ির হর্ন আর অসংখ্য মানুষের কোলাহলের মধ্যেও সেই আলোকে বড় রহস্যময় মনে হচ্ছে। হঠাৎ খয়েরী ডানার একটা পাখি উড়তে দেখি এখানেওখানে। কী নাম পাখিটার? কে জানে! নামধাম যা-ই হোক, আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে পাখিটার ওড়াউড়ি দেখতে লাগলাম। ইচ্ছে করছে অনন্তকাল ধরে আমি এই পাখিটার ওড়াউড়ি দেখি। আহা, শুধু বেঁচেবর্তে থাকাতেই যেখানে কতো কতো রঙ, সেখানে সারাজীবন মানুষ এতো এতো প্রত্যাশা করে কেন? কোনো মানে হয়!   

Comments