স্বার্থ অন্ধ

শহিদুল ইসলাম আকাশ 

সালিশি বৈঠক চলছে। 

দুই ভাইয়ের, একে-অপরের বিরোধ। পৈতৃক সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা হয়েছে আগেই, এখন সেই সম্পত্তির সীমানা নিয়ে বিরোধ। দুই ভাইয়ের একে-অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। কথায় কথায় একজন আরেকজনকে গালিগালাজ করে যাচ্ছে সমানে। পরস্পর পরস্পরের দিকে তেড়েও যেতে চাইছে একটু পরপর। এরমধ্যেও সালিশ চলছে।

সার্ভেয়ার নিযুক্ত করা হয়েছে দুই পক্ষেরই। সার্ভেয়াররা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, সম্পত্তির পরিসংখ্যান তৈরি করলেন। সীটের নিরিখে সাদা কাগজে স্কেচ বানিয়ে পরিমাপে গেলেন।

একটা দুটো জমি মাপার পর, পুকুরের অংশটা পরিচিহ্নিত করতে গিয়ে, দু'জনেরই বনিবনা হলো না। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো দুই ভাইয়েরই। একটা সময় একজন আরেকজনের শার্টের কলার চেপে ধরে বসলো। মুহূর্তেই দু'জন দু'জনকে ধাক্কাধাক্কি, কিল-ঘুষি শুরু হয়ে গেলো হঠাৎ। তাদের ছাড়াতে গিয়ে সালিসানদের কয়েকজনকেও আহত হতে হলো। একটা সময় দুই ভাইকে কোনো মতে থামানো গেলো। ততক্ষণে রক্তারক্তি অবস্থা দুই ভাইয়েরই।

সালিশ স্থগিত করে পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো-- পরের সপ্তাহের শনিবার আবার বসবে সালিশ।

বড় ভাইকে তার শালা সম্বন্ধীয় একজন এসে ধরলো, খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিয়ে একটা চেয়ারে বসালো তাকে। ছোট ভাই তখনো, মাটিতে পড়ে আছে, নাকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে তার। সালিসানদের কয়েকজন তাকেও ধরে অন্য আরেকটা চেয়ারে বসালেন। ডাক্তার ডাকা হলো। 

তাদের চিকিৎসা চলছে, আমি অদূরে আরেকটা চেয়ারে বসে দুই ভাইকে দেখছি। এই দুই ভাইকে আমার ছোটবেলা থেকে আমি দেখে এসেছি। ছোটজন কালাম আমার প্রায় সমবয়সী, তার থেকে বছরদুয়েকের বড় হবে বড়জন ইউনুছ। নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসলো আমাকে৷

সেই ছোটটি থাকতে দুই ভাই একজন-আরেকজনের হাত ধরে স্কুলে যেতো। গরমের দিনে একসাথে পুকুরে দাপাদাপি করতো। বাড়ির পাশের খেলার মাঠে দুই ভাই মিলে ফুটবল খেলতে নেমে যেতো। একবার কালাম জটিল জ্বরে পড়লে, প্রায় পনেরো দিনের মতো তাকে হাসপাতালে থাকতে হয়, তখন দিনরাত হাসপাতালে থেকে ভাইয়ের সেবাশুশ্রূষা করেছে ইউনুছ-- যেন অসুখটা কালামের নয়, ইউনুছেরই। আরেকবার খেলার মাঠে মারাত্মক ব্যথা পায় ইউনুছ, তখন মাঠের মধ্যেই ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না কালামের! সেই দুই ভাই-ই কিনা আজ, সামান্য কিছু সম্পত্তির জন্য, পরস্পরের বিরুদ্ধে এতোটাই সহিংস হয়ে উঠলো! বিশ্বাস করতেও কষ্ট হতে লাগলো আমার।

বলা হয়, স্বার্থ অন্ধ। স্বার্থের ফেরে পড়লে, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনও অমানিশার অন্ধকার ঠেকে। সম্পর্কের সংজ্ঞাও পাল্টে যায় তখন। সত্যিই তাই।   

Comments