ডাক্তার

শহিদুল ইসলাম আকাশ

জঙ্গি সংগঠন 'শহীদ হামজা বিগ্রেডে' অর্থায়নের অভিযোগে বছর দুই আগে তিন আইনজীবী গ্রেফতার হয়েছিলেন। জঙ্গিদের তাঁদের দেওয়া টাকার অংকটাও চোখ কপালে ঠেকার মতো__১ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা! কথা হচ্ছে, একজন আইনজীবীর আয় কতো? 

আইনজীবীদের একটা নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করা কি উচিত নয়? একইভাবে ডাক্তারদের ফিয়ের বেলায়ও তা প্রযোজ্য।

আইনজীবী বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা নিতান্ত অপ্রতুল। তবে ডাক্তারদের সম্পর্কে আমার কিঞ্চিত অভিজ্ঞতা আছে।

আইনজীবীরা এমন জঘন্য কাজে জড়িত থাকার কথা জানলেও, আশার কথা, ডাক্তারদের বিষয়ে চোখ কপালের তুলার মতো এমন গর্হিত কাজের খবর অবশ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

ডাক্তারদের ব্যপারে আমার কিঞ্চিত অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলি__মিশ্র অভিজ্ঞতা__

সেভেন, এইটে পড়ার সময় একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে আমার এক বন্ধুর তলপেটে বল লেগে মুহূর্তেই বেহুঁশ হয়ে গেলো। সবাই সে বন্ধুকে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে, নাকের আগায় লেবুর রস দেওয়ার মতো নানাবিধভাবে সুস্থ করতে চাইলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। শেষে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ডাক্তার আনতে ছুটলাম।

আমাদের গ্রামে তখন একজনই পাস করা ডাক্তার আছেন, তাঁর কাছেই গেলাম। ডাক্তার সাহেব আমাদের কথা শুনে বললেন, 'তোমরা তো ছোট ছোট বাচ্চা, রোগী দেখার পর আমার ফি দেবে কে?' আমরা যখন বললাম, সে খুব গরীব ঘরের ছেলে। তবু আমরা চেষ্টা করবো আপনার ফিটা যোগাড় করে দিতে।

তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, 'চেষ্টা করবো মানে! মাগনা ডাক্তারি শিখিনি। অনেক টাকা খরচ করে ডাক্তার হতে হয়েছে। ৩০০ টাকা লাগবে, দিতে পারলে যাবো।'

৩০০ টাকা তখন আমাদের জন্য অনেক টাকা। পরে আমরা এক পল্লী চিকিৎসকের সাহায্যে আমাদের সে বন্ধুকে সুস্থ করেছি বটে, কিন্তু তিনিও টাকার জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। আমরা আমাদের সামর্থ্যের যা আছে তা দিয়ে কোনোমতে বিদায় দিয়েছি। টাকা কম দেওয়াতে তিনিও বেজায় অসন্তুষ্ট হলেন।

সেই সময়ে আমাদের ছোট কোমল মনে ডাক্তার প্রসঙ্গে একটা ভীতি জন্ম নিলো। সেই ভীতি এখনো যে নেই তা কী করে বলি! 

তবে ভিন্ন অভিজ্ঞতাও আছে।

আট নয় মাস আগে আমার এক বন্ধু মোটরবাইক এক্সিডেন্টে গুরুতর আহত হলো। পায়ে জখম হয়েছে বেশ। ব্যথায় বন্ধুর চিৎকার চেঁচামেচি ছিলো বেশুমার। আমি এক অর্থোপেডিক্স ডাক্তারের কাছে বন্ধুকে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার সাহেব সদ্য পাস করে বের হয়েছেন। 

তিনি আমার বন্ধুকে দেখে বললেন, 'মনে হচ্ছে রোগীর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। ওনাকে এম আর আই করাতে হবে।' আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমার আশংকা সত্যি হলে দ্রুত রোগীর অপারেশন করাতেও হবে।'

আমি বললাম, সে তো বিশাল খরচের ব্যাপার। আমার এই বন্ধুর সে রকম আর্থিক সঙ্গতি নেই।

তিনি বললেন, 'ধনীদের চিকিৎসা হবে, দারিদ্রের হবে না__এটা কেমন কথা?'

তিনি প্যাড টেনে এম আর আই টেস্ট লিখলেন। নিচে তাঁর কমিশনের টাকাটা ডিসকাউন্ট লিখে সই করে দিলেন। তাঁর ফিও নিলেন না।

আসার সময় তিনি পুনরায় ডেকে বললেন, 'আমরা এ প্রজন্মের ডাক্তার। ধনী গরীর নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। আদর্শ বলে একটা ব্যপার আমরা কিছু মানুষ হৃদয়ে লালন করার দুঃসাহস দেখাবার ব্রত নিয়ে এই পেশায় এসেছি।'

আমাদের চারপাশে নিশ্চয় এই ডাক্তারের মতো আদর্শবান মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এমন আদর্শবান মানুষরা আছেন বলেই আমরা এখনো বিশ্বাস রাখি: এদেশের আকাশের নীলিমা কখনোই হবে না ফেরারি, শুদ্ধাচারী গাছপালা সবুজের পতাকা ওড়াবেই ঠিকই।

তিন আইনজীবী জঙ্গিদের অর্থায়ন করেছেন, কিন্তু এই প্রজন্মের কিছু আইনজীবীও নিশ্চয় সেই ডাক্তারের মতো আছেন__যাঁরা আদর্শ নামের বিষয়টা হৃদয়ে লালন করার দুঃসাহস রাখেন।

সেই সব আদর্শবান মানুষদের জন্য নিরন্তর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।   

Comments