যখনই মন খারাপ হবে

শহিদুল ইসলাম আকাশ

গতকালের ঘটনা। সময় বিকেল ৫ টা। একে সিনেমাটিক বললেও কম বলা হয়ে যায়।

আন্দরকিল্লা থেকে চকবাজার যাচ্ছিলাম। প্রাইভেটকারে ড্রাইভার ছাড়া যাত্রী আমরা তিনজন-- আমার এক বন্ধু, আমি এবং এক ছোট ভাই। চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মহসিন কলেজ ছুটি হয়েছে তখন। রাস্তায় ছাত্রছাত্রীদের মুখর কলরব। এমন ভীড়ে ড্রাইভারকে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছিলো। কচ্ছপগতিতে গাড়ি চলছে। কলেজ দু'টি পেরিয়ে কিছুদূর এসে রাস্তা একটু ফাঁকা পাওয়াতে ড্রাইভার যেই গাড়ির গতি বাড়ালো, অমনি এক ছাত্রী হঠাৎ গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেলো। ধাক্কাটা এতোটাই জোরে লেগেছে যে, গাড়ির লুকিংগ্লাস ভেঙে নিচে পড়ে গেলো মুহূর্তেই, জানালার কাঁচেও ফাটল দেখা দিলো। 

ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করলো, আমি বাধা দিলাম, বললাম, এভাবে মেয়েটাকে ফেলে যাওয়া অমানবিক তো অবশ্যই, কাপুরুষোচিত ব্যাপারও হয় তা। 

রাস্তার এক পাশে গাড়ি পার্ক করা হলো। আমি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে ছুটলাম। ড্রাইভার এবং আমার অন্য দুইজন সঙ্গী গাড়ির মধ্যে বসে রইলো। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা ভীত।

মেয়েটার কাছে গিয়ে দেখি, তার পায়ে রক্ত ঝরছে। হাতের কনুইয়েও মারাত্মক জখম হয়েছে। কপালেও আঘাতের চিহ্ন। তার বইপত্রগুলো রাস্তার এখানে-ওখানে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। ভাগ্যিস সামনে অথবা পিছন থেকে আর কোনো গাড়ি আসেনি তখন, নয়তো আরো বড় ধরনের কিছু হয়ে যেতো। মেয়েটাকে বললাম, 'আমি ওই গাড়িরই যাত্রী। আপনাকে এখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া আমার পরম কর্তব্য।'

এই সময় অদূরে পার্ক করে রাখা আমাদের গাড়িটাকে কিছু বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ঘিরে ধরে ফেললো। এক ছাত্র ড্রাইভারকে গাড়ির ভেতর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসার উপক্রম করতে লাগলো। আহত মেয়েটা তা খেয়াল করলো। শরীরের ব্যথা নিয়েও খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে গেলো সেদিকে। চিৎকার করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতাকে বলতে লাগলো, 'ওনাদের ছেড়ে দিন। দোষ আমারই, আমিই অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলাম।' তার করুণ আকুতি, 'প্লিজ ছেড়ে দিন ওনাদের।'

আমি তখনো তাকে বলছিলাম, 'আপনার চিকিৎসাও জরুরী। আসুন আগে আশেপাশে কোনো ডাক্তারের কাছে যাই। অন্তত ফাস্ট এইড...'। মেয়েটা আমার কথা শেষ করতে দিলো না। বললো, 'আপনি বুঝতে পারছেন না, এসব ব্যাপারে উত্তেজিত পাবলিক অনেক কিছুই করে ফেলতে পারে। প্লিজ চলে যান এখনই।'

মেয়েটা দাঁড়াতেও পারছিলো না তখন। এরমধ্যে মেয়েটার দুই সঙ্গী, সম্ভবত বান্ধবীই হবে, মেয়েটার দুই পাশে এসে মেয়েটাকে ধরলো। মেয়েটা তখনো আমাকে বলে যাচ্ছে, 'চলে যান প্লিজ, প্লিজ...'। চারপাশে তাকিয়ে দেখি উত্তেজিত জনতার ভীড় বাড়ছে ক্রমশ। আমি গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ি স্থান ত্যাগ করলো দ্রুত।

গাড়িতে উঠে বসার আগে, একবার মেয়েটার দিকে তাকালাম, আঘাতের যন্ত্রণার ছাপ মুখে, তবু কী যে এক অপার মায়া তার সারা মুখাবয়বে!

সেই থেকে এখনো পর্যন্ত সেই মুখ আমার মনে গেঁথে আছে। সারাজীবন চোখের কাছে থেকেও, এক পলক চোখের আড়াল হতেই অনেকের মুখ ভুলে যাই আমরা, আবার এক পলকের দেখাতেই অনেককে মনে রেখে দিই সারাটা জীবন। এই মেয়েটার সাথে এই জন্মে আর দেখা হয় কিনা কে জানে! দেখা না-হলেও, এমন হৃদয়বতী নারীর মুখটাকে আমি ভুলতে চাইবো না কোনোদিনই। 

আমার যখনই কোনো কারণে খুব মন খারাপ হবে, আমি সেই মেয়েটার মুখ মনে করবো মনে মনে--যে আশ্চর্য মায়াময় মুখের দিকে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকা যায়; ক্লান্তিবিহীন। আমি নিশ্চিত, আমার মন খারাপটা আর একটুও থাকবে না তখন।   

Comments