জানতে ইচ্ছে করে

শহিদুল ইসলাম আকাশ

প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখি ফেসবুক নামের নীল মলাটের সাদা পাতায়। বছরের পর পর বছর ফেসবুকে এই যে নিরবিচ্ছিন্ন লেখালেখি__এর কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে? কোনো কোনো লেখকের কোনো কোনো বই কালোত্তীর্ণ হয়, লেখক বেঁচে না থাকলেও, মহাকালে তাঁর লেখা বেঁচে থাকে। কিন্তু ফেসবুকের এইসব ছিন্নবিচ্ছিন্ন লেখার আয়ু ঠিক কতোদিন? জানা নেই। রবীন্দ্রনাথের 'আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ'র মতো শতবর্ষ পর তো দূরের কথা দুই দিন আগের লেখাও দুই দিন পরে ফেসবুকে ক'জনই বা খুঁজে নিয়ে পড়ে!

ভবিষ্যতের কথা জানি না, আমরা যারা ফেসবুকে টুকটাক লিখি, আমাদের সে লেখা পড়ে কেউ যখন বাহবা দেন, অনুপ্রেরণা যোগান__তখন আর এইসব কাল বা মহাকালের কথা মাথায় আসে না, বেমালুম ভুলে থাকা যায়। নতুন কিছু লেখার জন্য আমাদের ভেতরটা আকুল করে উঠে। এই প্রাপ্তি তুচ্ছ করি, মনের সে জোর নেই।

এক বন্ধুর কথা বলি। নিউজিল্যান্ড প্রবাসী আমার এই বন্ধুর সাথে আমার পরিচয় এই ফেসবুকেই। আমার লেখা নিয়মিত পড়তেন তিনি। ফেসবুকে আমার প্রায় প্রথম দিকের বন্ধু। তিনি ক্যান্সারাক্রান্ত ছিলেন। 

অর্থের কোনো অভাব ছিলো না তাঁর। পৃথিবীর নানান দেশের নানা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোড করতেন তিনি। অসুস্থ; তবু কী অদম্য জীবনীশক্তিতে ফেসবুকে সরব থাকতেন তিনি! 

বলতেন, 'হাসপাতালের বেডে শুয়ে আপনার লেখাগুলো পড়ি। কখনো আপনি নতুন কিছু না লিখলে, আপনার পুরোনো লেখাগুলো খুঁজে খুঁজে পড়ি। এতো কম লিখেন কেন? বৈষয়িক বিষয়ে একটু কম সময় দিয়ে লেখালেখিটাকে নিয়মিত করুন।' তাঁর কথা শুনে মনে মনে ভাবতাম, যদি আর একজন মানুষও আমার লেখা না পড়ে, অন্তত আমার এই বন্ধুর জন্যই আমার নিয়মিত লেখা উচিত। এ যে আমার কতোখানি পাওয়া!

মাঝে একবার দেশে আসার কথা ছিলো তাঁর। এসে অবশ্যই আমার সাথে দেখা করবেন কথা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'প্রিয় লেখককে একবার চোখের দেখা দেখে তারপরই মরণ হোক!' 'প্রিয় লেখক' এই একটি কথা আমার গভীরে কোথাও জলপ্রপাতের শব্দ বয়ে দিয়েছিলো, স্রোতস্বিনী। 

তাঁর অসুস্থতার প্রসঙ্গ তুললে তিনি বলতেন, 'এই জগতে সুস্থতার দান যে কতোখানি, আমরা যারা অসুস্থ তাঁরাই বুঝি। আপনারা সুস্থ মানুষদের বোঝার কথা নয় কখনো। এই পৃথিবীর সব মহার্ঘ জিনিসের চেয়ে আমাদের সবার এই জীবনটাই অনেক বেশি দামি।' প্রচণ্ডরকম আবেগী হয়ে উঠে বলতেন, 'রাতের আকাশের উজ্জ্বল ওই চাঁদটাকে ঘিরে থাকে কতো অগণন তারা। এই তারার বাগান থেকে কোনো একটি তারা যদি ঝরে পড়ে, তাতে চাঁদের এমন কীইবা যায় আসে?'

একটা সময় দিনে দিনে তাঁর অবস্থার অবনতি হতে লাগলো। জানালেন, ডাক্তার তাঁকে সময় বেঁধে দিয়েছেন, আর মাত্র ছয় মাসের মতো হয়তো তিনি বাঁচবেন। মাত্রই ছয় মাস! 

ফেসবুকে তিনি অনিয়মিত হয়ে গেলেন। কখনোকখনো আমার ইনবক্সে এসে ভেঙে ভেঙে ভুল বানানে লিখতেন, 'আমি আগের মতো মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকাতে পারি না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমার সময় ফুরিয়ে আসছে, এই জন্মে আপনার সাথে দেখা হবে না!' একদিন তিনি তাঁর এক আত্মীয়ের ফোন নাম্বার দিলেন আমাকে, বললেন, কখনো যদি দীর্ঘ সময় ফেসবুকে তিনি অনুপস্থিত থাকেন, আমি যেন বুঝে নিই তিনি আর বেঁচে নেই। তাঁর দেওয়া সে ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করে তখন আমি যেন তাঁর মৃত্যুর খবরটা জেনে নিই।

বছরের কাছাকাছি হয়ে গেলো, তিনি ফেসবুকে অনুপস্থিত। তাহলে তিনি কি আর বেঁচেবর্তে নেই! তাঁর দেওয়া ফোন নাম্বারটি এখনো যত্নে রেখেছি। বারবারই সে নাম্বারে ফোন করতে গিয়ে করে উঠতে পারি না। হাত কেঁপে উঠে। ফোনের ওপাশে যদি শুনি, তিনি নেই! এই পৃথিবীর কোথাও, কোত্থাও নেই তিনি! এই বিষাদ সইবার ক্ষমতা কি আমার আছে!

একদিন তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেখা হবে না কোনোদিন। তিনি কি ঠিক বলেছিলেন? কী জানি! কিন্তু আমি তা মানতে চাই না।

এই হাসিকান্নার সংসার ছেড়ে একদিন আমিও যাত্রা করবো অনন্তের উদ্দেশে। আমি বিশ্বাস রাখি, সেই জগতে আমাদের সবারই দেখা হবে, অবশ্য অবশ্যই তাঁর সাথেও। সেদিন আমার সেই বন্ধুর মুখোমুখি বসে, আমার সব লেখা তাঁকে পড়ে শোনাবো। দূরে বা কাছে সেই দিন আছেই।

তিনিও কি অনন্তের দেশে অনন্ত নক্ষত্রবীথির বাগান সাজিয়ে সেই দিনটিরই অপেক্ষায় থাকবেন বা আছেন__ মাঝেমাঝে বড় বেশি জানতে ইচ্ছে করে!  

Comments