পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্য

শহিদুল ইসলাম আকাশ

   ছেলেটি বললো, 'আমি এখন কী করবো?'

বললাম, 'কী আর করবে, সার্কাসে যোগ দাও, ক্লাউনের মতো রঙ মেখে সঙ সেজে মানুষ হাসাও।'

ছেলেটি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো, 'আপনি ব্যাপারটা নিয়ে ফান করছেন দেখি!'

আমি মোটেই ফান করছিলাম না। ছেলেটির বুকে সাহস আছে, সাহস না-থাকলে কেউ তার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে না। বিপুল বিত্তবৈভবের মালিকের একমাত্র সন্তান, এমএ পাস করেছে গেলো বার__সেই ছেলেই কিনা বাংলা সিনেমার নায়কের মতো এক সিএনজি অটোরিকশা চালকের মেয়েকে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেললো! মেয়েটিও অবশ্য শিক্ষিতা, এ বছর বিএ পাস করেছে। কিন্তু এখন শেষ ফিনিশিং দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে, তার পরিবারে ব্যাপারটা কীভাবে জানাবে তা বুঝতে পারছে না সে। তার মতে, যতো শিক্ষিতাই হোক কোনো সিএনজি অটোরিকশা চালকের মেয়েকে তার বাবা মেনে নেওয়ার মতো না। তার মার দিকের অবস্থা সম্পর্কে সে অবশ্য নিশ্চিত, মাকে ইতিমধ্যে বলেওছে সে। মারও ভয় বাবাকেই। তাই আমার দ্বারস্থ হওয়া, আমি যদি কোনোভাবে তার বাবাকে বুঝিয়ে বলতে পারি! জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার তা এড়িয়ে যাওয়া উচিতও নয়। বড় আশা করে ছেলেটি আমার কাছে এসেছে, একটু চেষ্টা করে ব্যাপারটা মীমাংসা করতে পারলে, আমার নিজেরও ভালো লাগবে।

তবু তাকে বললাম, 'এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর অন্যতম হলো, ভালোবেসে কাউকে বিয়ে করা, অনেকটা একা একা যুদ্ধজয় করার মতোই। তুমি সে অসাধ্যকে সাধন করেছো। পরের স্টেজেও তুমি সফল হবে, নিজে চেষ্টা করে দেখো।'

ছেলেটি নাছোড়। তার বাবা আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন, আমাকেই তার বাবার কাছে গিয়ে তার বউকে ঘরে তুলার ব্যাপারে কথা বলতে হবে__ছেলেটির সনির্বন্ধ অনুরোধ। অনুরোধ আমলে নিলাম।

পরদিন তার বাবার কাছে গেলাম। এ কথা সে কথার পর ছেলের প্রসঙ্গটা আনতে চেষ্টা করলাম। বললাম, 'ধরুন আপনার ছেলে কোনো এক সিএনজি অটোরিকশা চালকের মেয়েকে ভালোবাসে এবং একটা সময় বিয়ে করেও ফেলে__তখন কী করবেন আপনি?'

তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। আমার কথা শুনে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন হয়তো, বললেন, 'হঠাৎ এই কথা বললে কেন তুমি? আমার ছেলে কি এমন কিছু করেছে?'

বললাম, 'যদি করে?'

তিনি রেগেমেগে একাকার, চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলেন, থেমে থেমে বলতে লাগলেন, 'এমন কিছু যদি সে করে তাহলে... তাহলে আমি তাকে ত্যাজ্য করে দেবো, এ জীবনে তার মুখ দেখবো না কখনো।'

একটা সময় তিনি শান্ত হলেন, যখন আমি বললাম, 'আপনার ছেলে এই কাজ করেছে এবং ইতিমধ্যে বিয়েও সম্পন্ন হয়েছে তাদের। মেয়েটিকে ছাড়া সে বাঁচবে না। আপনার ছেলেই যদি বেঁচে না-থাকে, তাহলে আপনার এতো বিষয়সম্পত্তির কী অর্থ আছে বলুন? তাছাড়া আপনার ছেলে শিক্ষিত, নিজের ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা তার আছে। মেয়েটিও লেখাপড়া জানা মেয়ে। এই সব কিছু বিবেচনা করে তাদের মেনে নেওয়াই মঙ্গল নয় কি?'

আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তিনি। অবাক বিস্ময় মুখাবয়বে__কপাল কুঁচে ভাঁজ পড়েছে কপালে, চোখ দু'টি যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে, চড়ুই পাখির মতো ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। আমার যা বলার বলেছি, আমাকে দেয়া ছেলেটির দায়িত্ব পালন করেছি। আমি জানি না, শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর ছেলের বিয়েটা মেনে নেন কিনা! 

বেরিয়ে আসার সময় বাড়ির গেটের বাইরে দেখি ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে, কদ্দূর কী হলো জানতে চাইলো সে। আমি তাকে বিভ্রান্ত করার মতো এক ধরণের হাসি দিলাম। যে হাসির অর্থ কাজ হয়েছে এবং একই সাথে হয়নিও গোছের।

এর দুই মাস পরের কথা। এক সকালে ছেলেটি আমার বাসায় এসে হাজির। সাথে মেয়েটিও। ছেলেটি জানালো, তার বাবা তাদের মেনে নিয়েছে। পরের মাসের সাত তারিখ শুক্রবার তাদের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। বললো, 'আপনার কথায় বাবা রাজি হয়েছেন। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না আপনাকে।' মেয়েটিও আমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালো।

আমার সামনে বসে তারা যখন কথা বলছিলো, তখন মনে হলো, কী সুখ দু'টি মানুষের! কী অপার সুখি দু'টি মানুষ! যাওয়ার সময় তারা পরস্পরের হাত ধরে যখন হেঁটে যাচ্ছিলো, এতো ভালো লাগছিলো তাদের__পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্যটি যেন আমার চোখের সামনে দেখতে পেলাম তখন।

Comments