ছাফা কাকু

শহিদুল ইসলাম আকাশ 

   ছাফা কাকু আমাদের আপন চাচা ছিলেন না। প্রতিবেশী ছিলেন। আমার বাবাকে ভাই বলতেন বলে আমি এবং আমার অন্য ভাইবোন তাঁকে কাকু ডাকতাম।

হঠাৎ হঠাৎ আমাদের বাসায় এসে হাজির হতেন তিনি। বাড়ির বড়দের চেয়ে আমরা ছোটদের সাথেই বেশি সময় কাটাতেন তিনি। নানানরকম মজার মজার গল্প বলতেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে তার সেইসব গল্প শুনতাম। বেশিরভাগই জীবজন্তুর গল্প, তাই আমরা ছোটদের বিশেষ মনোযোগ পেতেন তিনি।

ছাফা কাকুর গল্পে প্রায়ই 'মামু' উপস্থিত হতো। এই 'মামু' রক্তমাংসের হলেও, মানুষ ছিলো না। শিয়ালকে তিনি 'মামু' বলতেন। বলতেন, 'বনের জীবজন্তুর মধ্যেও অনেকরকম চরিত্র থাকে, রাজা রানী থেকে এই মামাটামাও। শিয়ালই একমাত্র প্রাণী, সেখানে মামা একমাত্র সে-ই।' 

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতাম, 'কথা কি সত্য, ছাফা কাকু?' ছাফা কাকু বিরক্ত না-হলেও, বিরক্তের ভাব দেখাতেন, বলতেন, 'গল্পের মাঝখানে প্রশ্ন করো কেন? গল্পের লাইন ছুইটা যায়।' বলে আবার পুনরায় গল্পে ফিরে যেতেন। সেই একই মামু মামু, শিয়াল মামু। হঠাৎ কেউ আবার থামিয়ে দিতাম, বলতাম, 'আচ্ছা, শিয়াল মামুর বউ নাই? মানে মামী আর কি?' ছাফা কাকু ভ্রু কুঁচকে বলতেন, 'চিন্তার বিষয়। মামা থাকলে মামীও তো থাকারই কথা!' 

একদিন ভিন্ন একটা গল্প বলছেন, বাঘ আর কুমিরের লড়াইয়ের গল্প। উপসংহারে 'শিয়াল মামু' এসে উপস্থিত। বললেন, 'শিয়াল মামু এসে জোরে একটা পাদ দিলো। পাদের গন্ধে বাঘ ও কুমির দু'দিকে দৌঁড় দিলো।' শুনে আমরা হিহি করে হাসতে লাগলাম। ছাফা কাকু ধমক দিয়ে বললেন, 'হাসো ক্যান তোমরা, হাসবা না। তোমরা পাদ দেও না?' তারপর আমাদের সবার উদ্দেশে বললেন, 'শুনো, এই জগতে সবচেয়ে বেশি গন্ধ কোন প্রাণীর পাদে জানো? জানো না দেখছি। সব তো দেখি একেকটা গাধা। আরে কোন প্রাণীর আবার, শিয়াল মামুরই।' আমরা কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে থাকতাম ছাফা কাকুর দিকে, কথা কি সত্য নাকি!

ছাফা কাকু এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্তের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছেন অনেক বছর আগে। সেই জগতেও এইসব দিনরাত্রি আছে কি না কে জানে! থাকলে সেখানেও নিশ্চয় তিনি বাচ্চাদের আসর বসিয়ে গল্প জমিয়ে তুলেন আজও!

'শিয়াল মামু'র পাদের গন্ধের কথাটা কুৎসিত শুনালেও, ইদানীং সেই গল্পটা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাচ্ছে, তাই এই স্মৃতিচারণ। এখন তো ভোটের মৌসুম। এই মৌসুমে কিছু মানুষ ভোট নিয়ে এমন সরব যে, তাদের কথা গন্ধের মতো মনে হয়। এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে চোখ বুজে থাকলেই শুধু নয়, নাকটাও বন্ধ করে রাখার মতো ব্যাপার। এইসব 'বুদ্ধিজীবী' মহলের কথাগুলোতে এতোটাই গন্ধ যে, ছাফা কাকুর গল্পের 'শিয়াল মামু'র গন্ধও যেন এর কাছে নস্যি।

Comments