হিমু ও রূপা
শহিদুল ইসলাম আকাশ
হুমায়ূন আহমেদ-সৃষ্ট অসাধারণ এক চরিত্রের নাম, 'হিমু'। উপন্যাস থেকে উঠে এসে এই চরিত্র মিশে গেছে প্রাত্যহিক জীবনেও, অনেকেরই নিজে হিমু হতে একটুও দ্বিধা নেই। হিমু__জাগতিক কোনো কিছুর প্রতিই যার কোনো লোভ নেই। আকাশের মতো বিশাল একটা হৃদয় বুকে ধারণ করেও__যে নিদারুণ হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়ে যায় প্রতি মুহূর্তে। একজন লেখকের কী অপরিসীম ক্ষমতা, ভাবলে অবাক হই! সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে আর কোনো লেখকের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে এমন নজির আছে কিনা আমার জানা নেই।
উপন্যাসের হিমুর সাথে পরিচয় ছিলো অনেক আগেই, কিন্তু বাস্তবের হিমুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০১১ সালের একুশে বইমেলায়। তখন হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে ছিলেন। 'অন্যপ্রকাশে'র স্টলে বসে তাঁর বইতে তিনি বিরামহীন অটোগ্রাফ দিয়ে যাচ্ছেন। স্টলের বাইরে দীর্ঘ লাইন, হুড়োহুড়ি। ভীড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী মোতায়েন করতে হলো এক পর্যায়ে। আমিও আছি সেই লাইনে। দীর্ঘ অপেক্ষা। হঠাৎ খেয়াল হলো একদল হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে মেলার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, খালি পায়ে। তাঁদের মধ্যে যুবক যেমন আছেন, আছেন অশীতিপর বৃদ্ধও। এমনকি নানা বয়সী নারীও আছেন। অবশ্য নারীদের পোশাকের রঙের ভিন্নতা আছে, হলুদ নয়, নীল। তাঁদের পায়েও কিছু পরা নেই।
এইসব নারীরাও কি হিমু? পুরুষ হলে হিমু, আর নারী হলে 'হিমি' এরকম বৈষম্যের ধারণা থেকে দূরে থাকার কথা হুমায়ূন আহমেদ নিজেই তাঁর বিভিন্ন লেখায় জানিয়েছেন। সেই অর্থে তাঁরাও হিমু।
প্রথমে ভাবলাম, এইসব হয়তো প্রকাশকের কাণ্ড, বইয়ের বিক্রি বাড়াতে বিজ্ঞাপন বৈ কিছু না। কিন্তু আমি লাইন থেকে সরে যখন তাঁদের সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেলাম, তখন একজনের কাছে 'আপনি কি হিমু?'__এমন প্রশ্ন রাখতেই চমৎকৃত হওয়ার মতোই ছিলো তাঁর উত্তর__'আই এ্যম নো বডি; আমি কেউ না'। বললেন, তাঁরা দেশের নানাপ্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন, বইমেলায় প্রিয় লেখকের দর্শনলাভের আশায়।
এই ফেসবুকেও আমার অসংখ্য 'হিমু' বন্ধু আছে। তাঁদের নানা সংগঠনও আছে। সংগঠনগুলোর নামও আছে__হিমু পরিবহন, আমরা হিমু, হিমুরা...। এইসব হিমু বন্ধুদের কারো কারো সাথে আমার মাঝেমাঝে চ্যাটে কথাবার্তা হয়। কথা বলতে আমার নিজেরও ভীষণ ভালো লাগে। সবাই লেখাপড়া জানা, শিক্ষিত। তাঁদের ভাবনার বিশালতা দেখে অভিভূত হই।
একটু আগের কথা, এক 'হিমু' বন্ধু চ্যাটে এলেন। তাঁর সাথে আমার নিম্নোক্ত কথাবার্তা হলো:
হিমু: আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমা। জোছনা কি দেখছেন?
আমি: হ্যাঁ। আমি হিমু নই যদিও, তবু হিমুদের মতো জোছনা আমাকেও প্রবল টানে। জোছনা রাতের কাছে এসে দাঁড়ালে মনে হয়, এই পৃথিবীর কোথাও কোনো অশান্তি নেই। আপনি দেখছেন না?
হিমু: জি দেখছি। দেখতে দেখতে এতোক্ষণ রূপার সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। একটু আগ পর্যন্তও।
আমি: রূপা?
হিমু: আমি যেহেতু হিমু, আমার জীবনে যে নারীটি খুব করে জড়িয়ে আছে, তার নাম আর যাই হোক__আমি তাকে রূপা নামে ডাকাই তো সঙ্গত, নাকি?
আমি: কী জানি! তা রূপার সাথে কী কথা হলো?
হিমু: বলেছি আমি এক্ষুণি যাচ্ছি তাদের বাসায়। অনেকদিন দেখি না তাকে।
আমি: এই মধ্যরাতে সত্যিই কি আপনি 'রূপা'র কাছে যাবেন?
হিমু: না। রূপা তার প্রিয় শাড়ি, কপালে রঙিন টিপ, চোখে কাজল এবং এক হাত চুড়ি পরে আমার অপেক্ষায় থাকবে। অপেক্ষায় থাকবে এটা জেনেও যে, আসবে বললেও, তার হিমু আদৌ আসবে না।
এই পর্যায়ে এসে 'হিমু'র সাথে কথোপকথনের ইতি টানলাম। বললাম, ভালো থাকবেন, পরে কথা হবে। তিনিও সম্মতি জানালেন।
ইতি টানলাম বটে কিন্তু আমার ভাবনা জুড়ে এখনো তার 'রূপা' আসন গেড়ে আছে। ভাবছি, দীর্ঘ সময় ধরে সেজেগুজে মেয়েটি নিশ্চয় সত্যি সত্যিই এই মূহূর্তে তার 'হিমু'র অপেক্ষায় আছে! যে হিমু আসবে বললেও, শেষতক আসবে না! এক চিলতে খোলা জানালার ফাঁক গলে রূপা নামের মেয়েটির বিছানায়ও নিশ্চয় এই মুহূর্তে এসে লুটে পড়েছে শুভ্র জোছনার ফুল, হাত বাড়িয়ে মুঠোয় ভরতে গেলেই যে ফুল নাই হয়ে যায়! বড়ই রহস্যময়। আমাদের এই জীবনেরই মতো।
হুমায়ূন আহমেদ-সৃষ্ট অসাধারণ এক চরিত্রের নাম, 'হিমু'। উপন্যাস থেকে উঠে এসে এই চরিত্র মিশে গেছে প্রাত্যহিক জীবনেও, অনেকেরই নিজে হিমু হতে একটুও দ্বিধা নেই। হিমু__জাগতিক কোনো কিছুর প্রতিই যার কোনো লোভ নেই। আকাশের মতো বিশাল একটা হৃদয় বুকে ধারণ করেও__যে নিদারুণ হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়ে যায় প্রতি মুহূর্তে। একজন লেখকের কী অপরিসীম ক্ষমতা, ভাবলে অবাক হই! সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে আর কোনো লেখকের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে এমন নজির আছে কিনা আমার জানা নেই।
উপন্যাসের হিমুর সাথে পরিচয় ছিলো অনেক আগেই, কিন্তু বাস্তবের হিমুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ২০১১ সালের একুশে বইমেলায়। তখন হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে ছিলেন। 'অন্যপ্রকাশে'র স্টলে বসে তাঁর বইতে তিনি বিরামহীন অটোগ্রাফ দিয়ে যাচ্ছেন। স্টলের বাইরে দীর্ঘ লাইন, হুড়োহুড়ি। ভীড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী মোতায়েন করতে হলো এক পর্যায়ে। আমিও আছি সেই লাইনে। দীর্ঘ অপেক্ষা। হঠাৎ খেয়াল হলো একদল হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে মেলার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, খালি পায়ে। তাঁদের মধ্যে যুবক যেমন আছেন, আছেন অশীতিপর বৃদ্ধও। এমনকি নানা বয়সী নারীও আছেন। অবশ্য নারীদের পোশাকের রঙের ভিন্নতা আছে, হলুদ নয়, নীল। তাঁদের পায়েও কিছু পরা নেই।
এইসব নারীরাও কি হিমু? পুরুষ হলে হিমু, আর নারী হলে 'হিমি' এরকম বৈষম্যের ধারণা থেকে দূরে থাকার কথা হুমায়ূন আহমেদ নিজেই তাঁর বিভিন্ন লেখায় জানিয়েছেন। সেই অর্থে তাঁরাও হিমু।
প্রথমে ভাবলাম, এইসব হয়তো প্রকাশকের কাণ্ড, বইয়ের বিক্রি বাড়াতে বিজ্ঞাপন বৈ কিছু না। কিন্তু আমি লাইন থেকে সরে যখন তাঁদের সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেলাম, তখন একজনের কাছে 'আপনি কি হিমু?'__এমন প্রশ্ন রাখতেই চমৎকৃত হওয়ার মতোই ছিলো তাঁর উত্তর__'আই এ্যম নো বডি; আমি কেউ না'। বললেন, তাঁরা দেশের নানাপ্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন, বইমেলায় প্রিয় লেখকের দর্শনলাভের আশায়।
এই ফেসবুকেও আমার অসংখ্য 'হিমু' বন্ধু আছে। তাঁদের নানা সংগঠনও আছে। সংগঠনগুলোর নামও আছে__হিমু পরিবহন, আমরা হিমু, হিমুরা...। এইসব হিমু বন্ধুদের কারো কারো সাথে আমার মাঝেমাঝে চ্যাটে কথাবার্তা হয়। কথা বলতে আমার নিজেরও ভীষণ ভালো লাগে। সবাই লেখাপড়া জানা, শিক্ষিত। তাঁদের ভাবনার বিশালতা দেখে অভিভূত হই।
একটু আগের কথা, এক 'হিমু' বন্ধু চ্যাটে এলেন। তাঁর সাথে আমার নিম্নোক্ত কথাবার্তা হলো:
হিমু: আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমা। জোছনা কি দেখছেন?
আমি: হ্যাঁ। আমি হিমু নই যদিও, তবু হিমুদের মতো জোছনা আমাকেও প্রবল টানে। জোছনা রাতের কাছে এসে দাঁড়ালে মনে হয়, এই পৃথিবীর কোথাও কোনো অশান্তি নেই। আপনি দেখছেন না?
হিমু: জি দেখছি। দেখতে দেখতে এতোক্ষণ রূপার সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। একটু আগ পর্যন্তও।
আমি: রূপা?
হিমু: আমি যেহেতু হিমু, আমার জীবনে যে নারীটি খুব করে জড়িয়ে আছে, তার নাম আর যাই হোক__আমি তাকে রূপা নামে ডাকাই তো সঙ্গত, নাকি?
আমি: কী জানি! তা রূপার সাথে কী কথা হলো?
হিমু: বলেছি আমি এক্ষুণি যাচ্ছি তাদের বাসায়। অনেকদিন দেখি না তাকে।
আমি: এই মধ্যরাতে সত্যিই কি আপনি 'রূপা'র কাছে যাবেন?
হিমু: না। রূপা তার প্রিয় শাড়ি, কপালে রঙিন টিপ, চোখে কাজল এবং এক হাত চুড়ি পরে আমার অপেক্ষায় থাকবে। অপেক্ষায় থাকবে এটা জেনেও যে, আসবে বললেও, তার হিমু আদৌ আসবে না।
এই পর্যায়ে এসে 'হিমু'র সাথে কথোপকথনের ইতি টানলাম। বললাম, ভালো থাকবেন, পরে কথা হবে। তিনিও সম্মতি জানালেন।
ইতি টানলাম বটে কিন্তু আমার ভাবনা জুড়ে এখনো তার 'রূপা' আসন গেড়ে আছে। ভাবছি, দীর্ঘ সময় ধরে সেজেগুজে মেয়েটি নিশ্চয় সত্যি সত্যিই এই মূহূর্তে তার 'হিমু'র অপেক্ষায় আছে! যে হিমু আসবে বললেও, শেষতক আসবে না! এক চিলতে খোলা জানালার ফাঁক গলে রূপা নামের মেয়েটির বিছানায়ও নিশ্চয় এই মুহূর্তে এসে লুটে পড়েছে শুভ্র জোছনার ফুল, হাত বাড়িয়ে মুঠোয় ভরতে গেলেই যে ফুল নাই হয়ে যায়! বড়ই রহস্যময়। আমাদের এই জীবনেরই মতো।


Comments
Post a Comment