আলোর খেলা

শহিদুল ইসলাম আকাশ

ইমতিয়াজ আর কণার মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব। কণার কাছে এই বন্ধুত্ব এখন আর বন্ধুত্বের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। কিন্তু কণা তা বুঝতে দেয় না ইমতিয়াজকে। কণা জানে, ইমতিয়াজ ভালোবাসে অনন্যাকে।

সেদিন জোছনা রাতে কণা যখন বাড়ির উঠোনে বসে জোছনা দেখছিলো, তখন ইমতিয়াজ এসে হাজির। কণার পাশে বসতে বসতে ইমতিয়াজ বললো, 'সূর্য যেমন জানে না এই পৃথিবীতে তার আলোর নামই রোদ, ঠিক তেমনই চাঁদও জানে না যে, পৃথিবীতে তার এই মোহন আলোর নামই জোছনা। কী বিচিত্র, তাই নারে কণা?'

: 'মাটির খবরই ঠিক মানুষ রাখে না আজকাল, আর তুই আছিস কিনা আকাশের ওই সূর্য আর চাঁদের আলো নিয়ে'। কণার জবাব।

একটু থেমে ইমতিয়াজ বললো, 'আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মরণোত্তর আমার চোখ দুটো দান করে দেবো।'

ইমতিয়াজের কথায় কণা একটুও অবাক হলো না। হঠাৎ হঠাৎ ইমতিয়াজ এমন অপ্রাসঙ্গিক কথা প্রায়ই বলে। তবু কণা জানতে চাইলো, 'তুই হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলি কী জন্যে?'

ইমতিয়াজ বিদ্বানের মতো বলতে বলতে লাগলো, 'চোখ আছে বলে আমরা জোছনার রূপ দেখতে পাই, কিন্তু অন্ধ যে জন সে জোছনার গন্ধটাই পায় হয়তো, রূপ যে দেখে না। কোনো মানে হয়, বল? আমার মৃত্যুর পর আমার চোখ দুটি দিয়ে কোনো অন্ধজন আলো ফিরে পাবে। কোনো কোনো রাতে যখন আকাশ ভেঙে এমনি করে জোছনা নামবে, সেই নিরুপম সৌন্দর্য দেখে মানুষটি হয়তো তখন মনে মনে বলে উঠবে: 'পৃথিবীর রূপ এতো সুন্দর!' এও কি কম পাওয়া বল?'

একটু থেমে ইমতিয়াজ আবার বলতে লাগলো, 'যখন এই পৃথিবীর কোথাও আমি থাকবো না। তখন কোনো এক অজানা অচেনা মানুষ জোছনা দেখতে দেখতে আমার কথা ভেবে কি চোখের পাতা ভেজাবে না? আমি নেই, কিন্তু আমার চোখেই কোনো একজন তার পৃথিবী দেখবে, ভাবতেই আমার ভেতরটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।'

তারপর কিছুক্ষণ পাশাপাশি বসে দুজনই চুপচাপ। নীরবতা ভাঙলো ইমতিয়াজই, 'এই চোখ বন্ধ কর, তোকে একটা আলোর খেলা দেখাই। আমিও বন্ধ করলাম চোখ।'

কণা যেন একটু অবাকই হলো, বললো, 'চোখ বন্ধ করে আলোর খেলা? এ আবার কী! চোখ বন্ধ করলে তো অন্ধকারই দেখা যাবে।তাছাড়া বাইরে এমন উথালপাতাল জোছনা রেখে চোখ বুজে থাকবো কোন দুঃখে?'

ইমতিয়াজ বললো, 'চোখ বন্ধ করলে অন্ধকার দেখা যায় না গাধা। চোখ বুজার পরও মানুষ কিছুক্ষণ বাইরের আলো ধরে রাখে, তারপর দেখা যায় যে অন্য এক রহস্যময় আলো__সেটাই হচ্ছে মনের আলো।'

কণা বেশ অভিভূত হলো ইমতিয়াজের কথাটায়। চোখ বুজলো সে।

কিছুক্ষণ পর ইমতিয়াজ বললো, 'এই মুহূর্তে আমার মনের আলোর ক্রিয়া শুরু হলো। তুই কি কিছু বুঝতে পারছিস কণা?'

চোখ বুজে থাকা কণা বেশ চমৎকৃত হলো। বললো, 'হ্যাঁ রে, এ যে সত্যিই যেন মনের আলোই।'

ইমতিয়াজের প্রশ্ন: 'সে আলোয় কী দেখছিস? কাউকে কি দেখতে পারছিস? আমি একজনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।'

: 'হ্যাঁ, আমিও দেখছি। একজনকে দেখছি।' কণার জবাব।

ইমতিয়াজ জানতে চাইলো, 'কে সে?'

কণার পাল্টা প্রশ্ন, : ’আগে তুই বল, তুই কাকে দেখছিস?’

ইমতিয়াজের সরল স্বীকারোক্তি, 'এই মুহূর্তে চোখ বুজে থাকা আমি, আমার মনের আলোয় অনন্যাকেই দেখছি। চাঁদের অনুপম আলোয় তাকে যেন স্বর্গের অপ্সরীর মতো লাগছে। এবার বল, তুই কাকে দেখছিস?'

: 'আমি যাকে দেখছি, তাকে ঠিক চিনতে পারছি না। অপূর্ব এক যুবাপুরুষ। গ্রীকপুরাণের দেবতার মতোই তার উজ্জ্বল মুখশ্রী। স্বর্গে শুধু পুরুষদের জন্যই অপ্সরী আছে, নারীদের জন্য এমন কোনো রূপবান পুরুষ স্বর্গে আছে কিনা জানি না। থাকলে, আমি যাকে এই মুহুর্তে আমার 'মনের আলো'য় দেখছি, তার মতো রূপবান কোনো পুরুষ স্বর্গে থাকার প্রশ্নই উঠে না।' কণা বললো।

দুজনেই চোখ খুললো একটা সময়। কণা এই আলোর খেলায় যে অভিভূত হয়েছে, তা ইমতিয়াজও বেশ বুঝতে পেরেছে। কারণ, কণা বারবারই বলছে, 'কী অপূর্ব, কী মনোরম, কী অসাধারণ এই মনের আলো! সত্যিই তুই একটা জিনিয়াস রে ইমতিয়াজ।'

কিছুক্ষণ দুজনই চুপচাপ। তারপর হঠাৎ 'যাই' বলেই উঠে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ। আর কিছু না বলেই পা বাড়ালো। একবারও পিছু ফিরে তাকালো না সে।

হঠাৎ কী হয়, কণার দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কণা ভুল বলেছে ইমতিয়াজকে। কণার মনের সে রহস্যময় আলোয় সে আসলে ইমতিয়াজকেই দেখেছে। মিথ্যে করে বলেছে যে, যাকে সে চোখ বন্ধ করে দেখেছে, সে অপরিচিত।

এই মুহূর্তে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কণার। কিন্তু পারছে না। বুকের মেঘ নামিয়ে এনে চোখে নিরবে সে তবু জোছনা দেখছে। আকাশ ভেঙে নেমে-আসা অনুপম জোছনা মাটির পৃথিবীকে স্বর্গ করে তুলেছে। এ যেন পৃথক এক অবয়ব পৃথিবীর।

কণা পুনরায় চোখ বন্ধ করে মনের আলোর খেলায় মেতে উঠলো। ক্ষণপরেই যখন অপরূপ, অনিন্দ্যসুন্দর আলো ভেসে উঠলো তার মনের ঘরে, কণা তখন ইমতিয়াজকেই দেখলো। এ যে অন্য এক জগত, ইমতিয়াজ না-জানালে কণার জানাই হতো না কখনো যে, মানুষের এমন আরেকটি জগত থাকতে পারে। যে জগতে সবাই স্বাধীন, যে জগতে ইমতিয়াজ অনন্যার নয়, একান্তই কণার।


কণা জানে এবং বুঝে যে, এই মনের আলোতেই ইমতিয়াজকে দেখে যেতে হবে চিরকাল; চিরটাকাল।

Comments