মহার্ঘ

শহিদুল ইসলাম আকাশ

সরকার অসহায়, দুঃস্থ ও স্বামী পরিত্যক্ত ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের 'বিজিডি' নামের সেবার মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেয়। একজন সুবিধাভোগী চব্বিশ মাস এই চাল পেয়ে থাকে।

গত মেয়াদের সুবিধাভোগীরা ২২ মাস চাল পেয়ে গেছে, তারা আর মাত্র দুই মাস চাল পাবে। তাই এখন থেকেই নতুন সুবিধাভোগী নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার দায়িত্ব যোগ্য নারীকেই এই সুবিধার জন্য নির্বাচন করে নেওয়া।

বাড়ি বাড়ি খবর নিচ্ছি কোন পরিবারের কী অবস্থা। এরমধ্যে বেশ কিছু নাম অনলাইনে আবেদন করেছি, বাকিগুলোর জন্য খোঁজখবর নিতে হচ্ছে। সময় মাত্র আর তিনটা দিন।

রাতে বাসায় ফেরার আগে এমনই একটি পরিবারে গেলাম। মর্জিনা নাম। মর্জিনার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, দুই মেয়ের বড়জন নাইনে, অন্যজন সেভেনে পড়ে। স্বামী আবদুল্লাহ দিনমজুর। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আবদুল্লাহর নাম ধরে ডাকলাম। ঝুপড়িমতো ছোট্ট ঘর, চারপাশে জরাজীর্ণ বাঁশের বেড়া, ঘরের চালে টিন কিছু আছে বাকিটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। বৃষ্টির দিনে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে নিশ্চয়।

আমার আওয়াজ শুনে আবদুল্লাহ দরজা খুলে দিলো। আমি ভেতরে ঢুকলাম। মর্জিনা ঘোমটা টেনে আমাকে সালাম দিলো। আমাকে দেখে স্বামীস্ত্রী দুইজন ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলো, সালাম দিয়েই মর্জিনা ভেতরঘর থেকে একটা মোড়া নিয়ে আসলো দ্রুত। 

আবদুল্লাহকে বললাম, 'তোমার মেয়ে দুটো কোথায়?' আবদুল্লাহ বলার আগেই ভেতর থেকে মেয়ে দুটো ছুটে এসে আমার পা ধরে সালাম করতে চাইলো। আমি তাতে বাধা দিলাম। মেয়ে দুটো লজ্জিত ভঙ্গিতে আমার সামনে দাঁড়ালো। পুরোনো ও ছেঁড়া পোশাকেও মেয়ে দুটিকে ইন্দ্রাণীর মতো কী অপরূপই-না লাগছে।

আমি আবদুল্লাহকে তাঁর স্ত্রীর আইডিকার্ডের ফটোকপি, স্ত্রীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ফোন নাম্বার, বসতভিটায় জমির পরিমাণ--এসব আগামীকাল আমার কাছে পাঠাতে বললাম। আবদুল্লাহ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

এরপর বের হতে যাবো এমন সময় মর্জিনা বললো, 'যদি কিছু মনে না নেন, তাইলে আইজ আমাদের লগে চারডা ভাত যদি খাইতেন...খাওনের সময় তো হইয়াই গেছে।' হাসলাম আমি, বললাম, 'আজ না। খাবো কোনো একদিন।' কিন্তু তাদের ছোট মেয়েটার কথায় আর 'না' করলাম না, সে যখন বললো, 'চাচা, আইজকে আমার জনমদিন। আপনেরে ভাত না-খাইয়া যাইতে দিমু না।'

খেতে বসলাম। তারা হয়তো ভাবেনি সত্যিই সত্যিই আমি খেতে বসে যাবো। তারা কিছুটা বিব্রতও হলো কি? আমি আসলে খাওয়ার চেয়ে তাদের জীবনযাপন দেখার কৌতূহল থেকেই খেতে বসে গেলাম। এই কৌতূহল আমার আশৈশব। 

মেয়ের জন্মদিন হলেও, আয়োজন যৎসামান্য--বেগুনভাজি, শুঁটকি দিয়ে রান্না করা সিমের বিচি আর কী একটা যেন সামুদ্রিক মাছ, সস্তা দামের। খেতে বসে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের বিব্রতভাব কেটে গেলো।

আবদুল্লাহর দুই পাশে তার দুই মেয়ে বসে খাচ্ছে, আবদুল্লাহ কখনো এই মেয়ে কখনো ওই মেয়ের মুখে নিজের হাতে খাওয়ার তুলে দিচ্ছে, এক পাশে বসে মর্জিনা বাবা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঘোমটার আড়ালে হাসছে। দেখে এক ধরনের আচ্ছন্নতা ছুঁয়ে গেলো আমাকে।

তাই দেখে মনে মনে বললাম, কতো কিছুর অভাব এই পরিবারটিতে--থাকাখাওয়া থেকে ভালো পরনের কাপড় এমনকি নানা সাধআহ্লাদ পূরণেরও। কিন্তু একটা জিনিসের কিছুমাত্র অভাব যেন নেই কোথাও। ভীষণ মহার্ঘ সেই জিনিসটার নাম হলো, 'ভালোবাসা'। অর্থবিত্তের চেয়েও এই প্রাপ্তির মূল্য যে কী তা যে বোঝার সে ঠিকই বোঝে। 

একমাত্র এই ভালোবাসার আশাতেই তো আমরা প্রতি মুহূর্তে নিঃশ্বাস নিই আর প্রশ্বাস ফেলি। সেই অর্থে অর্থবিত্তের পিছে এই অবিরাম ছুটাছুটি নিরর্থক নয় কি? তাহলে...!

আবদুল্লাহ ও মর্জিনা কি জানে, এই পৃথিবীতে কী ভীষণ সৌভাগ্য তাদের!     

Comments