কয়েদী

শহিদুল ইসলাম আকাশ

রাজনৈতিক মামলায় আমার এক আত্মীয়কে জেলে যেতে হলো। দীর্ঘ এক বছর তিন মাস জেল খাটতে হলো তাকে। এই সময়টাতে বেশ কয়েকবারই জেলখানায় আমি তাকে দেখতে গেছি।

জেলখানা ও হাসপাতাল, একটা সময় এই দুই জায়গাকে আমার কাছে ভিনগ্রহ মনে হতো যেন। প্রথম প্রথম আমি জেলখানায় কাউকে দেখতে ও যে করেই হোক হাসপাতালে যাওয়া থেকে পারতপক্ষে দূরে থাকতে চেষ্টা করতাম। জেলখানায় খাঁচার পাখির মতো মানুষের ছটফটানি দেখা যেমন কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা মনে হতো না; তেমনই হাসপাতালও। হাসপাতালে জন্ম যেমন অপেক্ষায় থাকে, অপেক্ষায় থাকে মৃত্যুও। জীবন অমোঘ নয়, মৃত্যুর মতো। জন্মমৃত্যু এক সাথে এক জায়গায় দেখাও আমার কাছে কেমন যেন বিব্রতকর অভিজ্ঞতার অন্য এক নাম ছিলো।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই দুই জায়গায় অনেকবারই দর্শনার্থী হয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। প্রথম প্রথম এড়িয়ে চললেও, এই দুই জায়গার প্রতি এক ধরনের আগ্রহও জন্ম নিলো একটা সময়__যাওয়াআসা করতে করতে যখন বুঝলাম, পৃথিবীর সব বড় বড় ড্রামাগুলো এই দুই জায়গাতেই বাস্তবে হয়।

এরপর থেকে পরিচিত কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে, দেখতে যাই নিয়ম করে। চেনাজানাদের মধ্যে কেউ আটক হয়ে জেলখানায় গেলে, সময়সুযোগ করে দেখে আসতে ভুল করি না। লেখালেখির নেশা আছে বলে, ওখানকার অভিজ্ঞতাগুলোও যদি কোনো লেখায় কাজে লাগে, এই আশায়।

তো; যে কথা বলছিলাম। কারাবন্দী আমার সেই আত্মীয়কে দেখতে যাই মাঝেমাঝে। একদিনের ঘটনা। লোহার ভারী নেটের ওপাশে তিনি, এপাশে আমি। তিনি তাঁর দুর্বিষহ কারা অভিজ্ঞতা বলছেন, আমি মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনে যাচ্ছি। 'ইলিশ ফাইল' 'কাঁচি ফাইল' নামে নানা নির্মম নির্যাতনের কথা তাঁর মুখ থেকে শুনছিলাম। অনেকরকম মানসিক নির্যাতনেরও নাকি শিকার হতে হয় বন্দী সাজাপ্রাপ্ত পুরোনো কয়েদিদের দ্বারা।

তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে 'খাঁচা'র এপাশ থেকে আমি বললাম, 'শুধু এমন জেলখানাতেই 'ইলিশ ফাইল' বা 'কাঁচি ফাইলে'র মতো নির্মমতা নেই, এখানেই শুধু পুরোনো কয়েদিদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে না__এরচেয়েও ভয়াবহ জেল আছে প্রত্যেক মানুষের বুকের মধ্যেই। যে জেলে সে নিজেই বন্দী নিজেই জেলার; একই সাথে নিজেই ফাঁসির আসামী এবং জল্লাদ। পার্থক্য শুধু সেই জেলে এমনই কোনো লোহার শিক নেই। নেই বলেই কারো দেখার ও বোঝার সাধ্যও নেই। সেই অর্থে আমরা সবাই-ই কোনো না কোনো কারায় বন্দী।'

মনে পড়ে আমার কথা শুনে সেদিন তিনি হু হু করে কেঁদে উঠেছিলেন। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। তাঁরও বুকের মধ্যে থাকা জেলখানায় নিশ্চয় আরো তীব্র কোনো কান্না বাঁধ ভাঙছে তখন, সেই কান্না দেখার মতো কোনো উপায় আমার ছিলো না। কারোরই থাকে না।

আহা, কী ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষমতা!   

Comments