বিয়ের দিন

শহিদুল ইসলাম আকাশ

'বারো বছর বয়স পর্যন্ত আমার মেয়ে আমি আর আমার স্ত্রীর সাথে একই বিছানায় ঘুমাতো। পরম আদরে আমি তার চুলে বিলি কেটে না-দিলে সে কিছুতেই ঘুমাতো না। ক্লাস সিক্সে উঠার পর থেকে মেয়ের মা মেয়েকে নিয়ে আলাদা রুমে থাকতে লাগলো। প্রথম প্রথম মেয়ে আমার রুমে এসে মাঝরাতে ডেকে উঠতো, 'বাবা, বাবা; তুমিও এসো না আমাদের রুমে। তুমি আমার চুলে বিলি কেটে না-দিলে আমার ঘুম যে আসে না বাবা।' আমি যেতাম। মেয়ের চুলে বিলি কেটে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে পুনরায় নিজের রুমে ফিরে আসতাম।

আস্তে আস্তে একটা সময় সে আমাকে ছাড়া থাকতেই যেন অভ্যস্ত হয়ে গেলো। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আর আমাকে খুঁজে না। আমার দরজায় এসে আর আমার ঘুম ভাঙায় না। মেয়ের প্রতি আমার একধরণের অভিমানও জন্মাতে লাগলো।

মেয়ে না-ডাকলেও আমার পাশের রুমেই তো সে আছে, এই বিশ্বাস বুকে নিয়ে আমি ঘুমাতে চেষ্টা করি, কিন্তু ঘুম আসে না। একদিন মেয়েকে যে অন্য কোনো ঘরে বউ হয়ে যেতে হবে।

মেয়ে হয়ে জন্মানোর এই এক সমস্যা, একদিন তাকে নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য এক অজানা অপরিচিত পরিবারকে নিজের করে নিতে হয়।'

নিজের মেয়ের কথা বলতে বসলে আজিজ মিয়াকে এমনই কথায় খুব পেয়ে বসে। আমি কখনো কখনো মন দিয়ে শুনি, কখনো কখনো বেজায় বিরক্তও হই__এক মেয়ের কথা আর কতো!

আজিজ মিয়ার একটাই মেয়ে, একমাত্র। দেখতে দেখতে কখন যে মেয়েটা বড় হয়ে গেলো আজিজ মিয়া বুঝতেই যেন পারেননি। ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে, প্রতিদিনই বিয়ের প্রস্তাব আসাই স্বাভাবিক। তারউপর আজিজ মিয়ার মেয়ের মতো এমন রূপবতী মেয়ে হলে তো কথায় নেই, দিনে দুইটা চারটা; এমনকি তারও বেশি প্রস্তাব আসবেই।

বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা মানুষের ঝামেলা আজিজ মিয়াকেও ঢের পোহাতে হলো।

ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকলে, মা-বাবাকেও অস্থিরতার মধ্যে থাকতে হয়, মেয়ে বাইরে কোথাও বের হলে সারাক্ষণই উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। আজিজ মিয়ারও হয়। আজিজ মিয়াও সিদ্ধান্ত নিলেন, একটা ভালো ছেলে দেখে এখন বিয়েথা সেরে ফেলা যায়।

একসময় পাত্রও পাওয়া গেলো পছন্দমতো। ছেলে ব্যবসা করে। পড়ালেখা জানা শিক্ষিত ছেলে। রিটায়ার্ড সরকারি কর্মকর্তার একমাত্র ছেলে।

সেই পাত্রের হাতেই বিয়ে ঠিক করা হলো। আগে অবশ্য মেয়ের কাছে জানতে চেয়েছেন, ছেলের সম্পর্কে তার কোনো মতামত আছে কিনা। মেয়ে জানিয়েছে, সে বাবার পছন্দকেই গুরুত্ব দিতে চায়।

সে পাত্রকেই মেয়ের বিয়ে দেওয়া হলো। বিয়ের দিন আমি উপস্থিত ছিলাম। খাওয়াদাওয়া, কাবিন ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে যখন মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় হলো, তখন আজিজ মিয়া ও তাঁর স্ত্রীর সে কি কান্না! সে কান্না দেখে আমারও চোখের পাতা ভিজে উঠলো, কান্না এমন ছোঁয়াচে হয়!

মেয়ের বিদায়ের পর একে একে সব আত্মীয়স্বজন সবাই চলে গেলেও আমি আরও কিছুটা সময় আজিজ মিয়ার কাছে থাকি। ভেতরবাড়িতে আজিজ মিয়ার স্ত্রী অনবরত কাঁদছেন, বারান্দায় বসে আজিজ মিয়াও ছোট্ট শিশুটির মতো কাঁদছেন।

আমি তাঁকে শান্তনা দিতে গেলে তিনি একটু থামলেন, চোখ মুছলেন, বললেন, 'অনেক বছর পর গতকাল মাঝরাতে মেয়ে আমার দরজায় এসে হাজির। আমাকে ডাকলো, বললো, 'বাবা, প্রতিরাতেই আমি তোমার দরজায় এসে দাঁড়াই কিন্তু তোমাকে ডাকি না। আমার খুব ইচ্ছে হয় সেই আগের মতোই তুমি আমার চুলে বিলি কেটে দাও আর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু সে ইচ্ছেটা বড় কষ্টে সংবরণ করি। তোমার শরীরটাও আজকাল ভালো যাচ্ছে না, হঠাৎ ঘুম ভাঙলে তোমার শরীর যদি আরো খারাপ হয়, এই ভয়ে তোমার ঘুম ভাঙাই না। বাবা, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে বাবা। তুমি কি আজ রাতে একটু আমার পাশে বসে আমার চুলে বিলি কেটে দেবে, আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না বাবা।'

বলতে বলতে আজিজ  মিয়া পুনরায় হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

Comments