শূন্য
শহিদুল ইসলাম আকাশ
এই সেদিনর কথা। কোরবানের দিন ছিলো। দুপুর দুইটার কিছু পরে এলাকায় একজনের মৃত্যুর খবর পেলাম। আনন্দের দিনটিতে বেদনার খবরে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। শুনে, মৃতের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।
বাড়িতে ঢুকার শ'খানেক গজ আগে তাদের পারিবারিক কবরস্থান। সেখানে মানুষের জটলা। কেউ একজন কবর খুঁড়ছে, কবর খোঁড়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। কবরের চারপাশে মানুষের ভীড়ের কারণে যে কবর খুঁড়ছে তাকে দেখা যাচ্ছে না।
সামনে এগিয়ে উঁকিঝুঁকি করে দেখতে লাগলাম। মানুষের ভীড় ঠেলে যেই কবরে চোখ গেলো, অবাক হতে হলো আমাকে--এ কী, কবর খুঁড়ছে দেখি আমাদেরই বন্ধু শরীফ!
অবাক হওয়ার কারণও আছে যথেষ্ট। আমরা বন্ধুদের মধ্যে শরীফের মতো ভীতু টাইপ আর দ্বিতীয়টি নেই। ভয়ে মৃত মানুষের মুখ দেখে না সে কখনো, কবর খোঁড়ার সময় কবরের পাশে দাঁড়ানোটাই তো অনেক দূরের ব্যাপার। এমনকী কোরবানের গরু জবাই করার সময়ও ভয়ে আশেপাশে থাকে না, রক্ত দেখলেই তার মাথা ঘুরে, হোক না তা নিছক গরুর রক্ত। সেই শরীফই কিনা আজ নিজেই কবর খুঁড়তে লেগে গেলো! বিচিত্র! মানুষের জটলা থেকে একজন বলে উঠলো, 'কবর খোঁড়ার মানুষ পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই ছেলেটা না-হলে কী যে হতো!' অন্য একজন বললো, 'কবর খোঁড়ানোতে নতুন হলেও, ছেলেটা কিন্তু ভালোই খুঁড়ছে।'
উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়ে শরীফের সাথে চোখাচোখি হলো আমার। সে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে আবার কবর খোঁড়ার কাজে মনোযোগ দিলো। আমি সেখান থেকে মৃতের বাড়ির দিকে এগোলাম। মৃত মানুষকে এক পলক দেখে আসা যাক।
ঘরের মধ্যে শুইয়ে রাখা মৃতের পাশে দাঁড়িয়ে মৃতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বাইরে সারিসারি করে রাখা একটা চেয়ারে বসলাম। ভেতরবাড়ি থেকে আওয়াজ আসছিলো, 'ময়ুতকে গোসল দিতে হবে। গোসল দেওয়ার কেউ আছে?' কেউ সাড়াশব্দ করলো না। মাওলানা সাহেব এসেছেন, কিন্তু তাঁর একার পক্ষে মৃতকে গোসল দেওয়া সম্ভব না, সঙ্গী একজন লাগবে।
এরমধ্যে খবর খোঁড়া শেষ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে কাপড়চোপড় পাল্টে শরীফ এলো। কাউকে এগিয়ে আসতে না-দেখে মাওলানার সাথে এবারও মৃতকে গোসল দেওয়ার জন্য সঙ্গী হলো সে। চারদিকে সাদা কাপড়ে ঢেকে ভেতরে মাওলানার সাথে গোসল দিতে লেগে গেলো শরীফ। বাইরে চেয়ারে বসে আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই। ভীতু শরীফ হঠাৎ এতো সাহসী হলো কী করে!
মৃতকে গোসল দেওয়া শেষ হওয়ার পর শরীফ বাইরে এলো। আমি তাকে ডাকলাম। আমার পাশে একটা চেয়ারে বসতে বললাম তাকে। শরীফ বসলো। ঘটনা কী জানতে চাইলাম, এই সাহস হঠাৎ কী করে হলো তার!
শরীফ হাসলো, বললো, 'কবর খোঁড়ার মানুষ পাওয়া যাচ্ছিলো না, উপায়ন্তর না-দেখে, এই কাজে আর অপেক্ষা না-করে, নিজেই লেগে গেলাম। কীভাবে যে খুঁড়তে পারলাম, আমি নিজেই অবাক। গোসল দেওয়ার সময়ও দেখি একই অবস্থা, কেউ নেই। এই কাজটাও নিজের হাতে করলাম। আমার ভয় হঠাৎ কোথায় যে পালালো, আমি তো নিজেই জানি না।'
একটু থেমে শরীফ আবার বললো, 'তবে কী জানিস, এই পৃথিবীতে কোনো কাজই আটকে থাকে না, কেউ না কেউ এসে তা করে দেয়। প্রকৃতি হয়তো কিছু কিছু বিষয় অসমাপ্ত রাখা পছন্দ করে না। তাই তো আমার মতো পাঁড় ভীরুও হঠাৎ কেমন সাহসী হয়--দেখলি তো?'
আমি শরীফের দিকে তাকিয়ে আছি। এ যেন অন্য এক শরীফ--যাকে আমরা অন্য বন্ধুরা ভীতু আর বোকা বলে ভাবতাম ও মানতাম। কিন্তু সে যে তা নয়, তা দেখে একরকম গর্বও হলো।
বড় বড় গণিতজ্ঞরা যেমন যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেন, শূন্য খুব তুচ্ছ হলেও, এই শূন্যই আবার অনেক বড় ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়। শরীফের মতো ভীরু প্রকৃতির ছেলেটাও আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে, মূলত এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই তুচ্ছ নয়। কিছুতেই না।
এই সেদিনর কথা। কোরবানের দিন ছিলো। দুপুর দুইটার কিছু পরে এলাকায় একজনের মৃত্যুর খবর পেলাম। আনন্দের দিনটিতে বেদনার খবরে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। শুনে, মৃতের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলাম।
বাড়িতে ঢুকার শ'খানেক গজ আগে তাদের পারিবারিক কবরস্থান। সেখানে মানুষের জটলা। কেউ একজন কবর খুঁড়ছে, কবর খোঁড়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। কবরের চারপাশে মানুষের ভীড়ের কারণে যে কবর খুঁড়ছে তাকে দেখা যাচ্ছে না।
সামনে এগিয়ে উঁকিঝুঁকি করে দেখতে লাগলাম। মানুষের ভীড় ঠেলে যেই কবরে চোখ গেলো, অবাক হতে হলো আমাকে--এ কী, কবর খুঁড়ছে দেখি আমাদেরই বন্ধু শরীফ!
অবাক হওয়ার কারণও আছে যথেষ্ট। আমরা বন্ধুদের মধ্যে শরীফের মতো ভীতু টাইপ আর দ্বিতীয়টি নেই। ভয়ে মৃত মানুষের মুখ দেখে না সে কখনো, কবর খোঁড়ার সময় কবরের পাশে দাঁড়ানোটাই তো অনেক দূরের ব্যাপার। এমনকী কোরবানের গরু জবাই করার সময়ও ভয়ে আশেপাশে থাকে না, রক্ত দেখলেই তার মাথা ঘুরে, হোক না তা নিছক গরুর রক্ত। সেই শরীফই কিনা আজ নিজেই কবর খুঁড়তে লেগে গেলো! বিচিত্র! মানুষের জটলা থেকে একজন বলে উঠলো, 'কবর খোঁড়ার মানুষ পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই ছেলেটা না-হলে কী যে হতো!' অন্য একজন বললো, 'কবর খোঁড়ানোতে নতুন হলেও, ছেলেটা কিন্তু ভালোই খুঁড়ছে।'
উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়ে শরীফের সাথে চোখাচোখি হলো আমার। সে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে আবার কবর খোঁড়ার কাজে মনোযোগ দিলো। আমি সেখান থেকে মৃতের বাড়ির দিকে এগোলাম। মৃত মানুষকে এক পলক দেখে আসা যাক।
ঘরের মধ্যে শুইয়ে রাখা মৃতের পাশে দাঁড়িয়ে মৃতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বাইরে সারিসারি করে রাখা একটা চেয়ারে বসলাম। ভেতরবাড়ি থেকে আওয়াজ আসছিলো, 'ময়ুতকে গোসল দিতে হবে। গোসল দেওয়ার কেউ আছে?' কেউ সাড়াশব্দ করলো না। মাওলানা সাহেব এসেছেন, কিন্তু তাঁর একার পক্ষে মৃতকে গোসল দেওয়া সম্ভব না, সঙ্গী একজন লাগবে।
এরমধ্যে খবর খোঁড়া শেষ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে কাপড়চোপড় পাল্টে শরীফ এলো। কাউকে এগিয়ে আসতে না-দেখে মাওলানার সাথে এবারও মৃতকে গোসল দেওয়ার জন্য সঙ্গী হলো সে। চারদিকে সাদা কাপড়ে ঢেকে ভেতরে মাওলানার সাথে গোসল দিতে লেগে গেলো শরীফ। বাইরে চেয়ারে বসে আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই। ভীতু শরীফ হঠাৎ এতো সাহসী হলো কী করে!
মৃতকে গোসল দেওয়া শেষ হওয়ার পর শরীফ বাইরে এলো। আমি তাকে ডাকলাম। আমার পাশে একটা চেয়ারে বসতে বললাম তাকে। শরীফ বসলো। ঘটনা কী জানতে চাইলাম, এই সাহস হঠাৎ কী করে হলো তার!
শরীফ হাসলো, বললো, 'কবর খোঁড়ার মানুষ পাওয়া যাচ্ছিলো না, উপায়ন্তর না-দেখে, এই কাজে আর অপেক্ষা না-করে, নিজেই লেগে গেলাম। কীভাবে যে খুঁড়তে পারলাম, আমি নিজেই অবাক। গোসল দেওয়ার সময়ও দেখি একই অবস্থা, কেউ নেই। এই কাজটাও নিজের হাতে করলাম। আমার ভয় হঠাৎ কোথায় যে পালালো, আমি তো নিজেই জানি না।'
একটু থেমে শরীফ আবার বললো, 'তবে কী জানিস, এই পৃথিবীতে কোনো কাজই আটকে থাকে না, কেউ না কেউ এসে তা করে দেয়। প্রকৃতি হয়তো কিছু কিছু বিষয় অসমাপ্ত রাখা পছন্দ করে না। তাই তো আমার মতো পাঁড় ভীরুও হঠাৎ কেমন সাহসী হয়--দেখলি তো?'
আমি শরীফের দিকে তাকিয়ে আছি। এ যেন অন্য এক শরীফ--যাকে আমরা অন্য বন্ধুরা ভীতু আর বোকা বলে ভাবতাম ও মানতাম। কিন্তু সে যে তা নয়, তা দেখে একরকম গর্বও হলো।
বড় বড় গণিতজ্ঞরা যেমন যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেন, শূন্য খুব তুচ্ছ হলেও, এই শূন্যই আবার অনেক বড় ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়। শরীফের মতো ভীরু প্রকৃতির ছেলেটাও আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে, মূলত এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই তুচ্ছ নয়। কিছুতেই না।
Comments
Post a Comment