একাকার হাহাকার

শহিদুল ইসলাম আকাশ

ফজলু শুধু আমাদের ক্লাসমেট ছিলো না, ক্রমশ সে হয়ে উঠে আমাদের ভালো বন্ধুও। নিতান্ত এক দারিদ্র ঘরের ছেলে। এতোটাই দারিদ্র যে, খেয়ে না-খেয়ে থাকে, এমনই অবস্থা। দারিদ্র হলেও, ফজলুর মেধা ও শান্তশিষ্ট স্বভাবের জন্য আমাদের বন্ধুমহলে তার আলাদা এক গুরুত্ব ছিলো।

তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি আমরা, সেই সময় ফজলুর কোন এক দূর সম্পর্কের হৃদয়বান আত্মীয় ফজলুর জন্য দুবাইয়ের ভিসার ব্যবস্থা করেন। ফজলুও মহাখুশি, বিদেশে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করে দুই হাতে টাকা রোজগার করবে আর ক্রমেই পরিবারের এই সীমাহীন দুর্দশা দূর করবে সে। ভিসার সাথে টিকিটেরও ব্যবস্থা সেই আত্মীয় করে দিলেন। দিন বিশেক পরে যাবার তারিখ। আত্মীয়ের শর্ত থাকে, মাসেমাসে বেতনের টাকা থেকে তিনি ভিসা ও টিকিটের টাকা কেটে রাখবেন।

টিকিট কনফার্ম হবার পর ফজলু একদিন আক্ষেপ করে আমাদের বললো, তার একটাও ভালো শার্ট নেই, গত ঈদে কেনা স্বল্পদামের প্যান্টটা যা একটু ভালো আছে, এই। কী পরে সে বিদেশে যাবে! আমরা কয়েকজন বন্ধু ফজলুকে আশ্বস্ত করলাম, 'এই নিয়ে চিন্তা করিস না তুই, আমরা বাসা থেকে পাওয়া আমাদের একদিনের হাতখরচের টাকা দিয়ে তোর জন্য অন্তত একটা নতুন শার্টের ব্যবস্থা আমরা করবো।'

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ফজলুর জন্য আমাদের শার্ট কিনতে হয়নি। মুন্নী নামের আমাদের এক সহপাঠিনী ফজলুকে মনে মনে খুব পছন্দ করতো। মুন্নীর কথাবার্তায় ফজলু যেমন তা বুঝতো, বুঝতাম আমরাও। বড়লোক বাবার মেয়ে মুন্নী, সে কিনা ফজলুর মতো একজন দারিদ্র ছেলের প্রেমে মজে আছে--আমরা তো রীতিমত অবাক।

তো এই মুন্নী মেয়েটি ফজলুর বিদেশ যাবার দু'দিন আগে, কলেজ ছুটির পর, ফজলুর জন্য কিনে আনা নতুন একটা শার্ট ও একটা প্যান্ট আমার হাতে দিয়ে বললো, এগুলো যেন আমি ফজলুর কাছে পৌঁছে দিই। এক সপ্তাহ আগে ফজলু কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়, মুন্নীর কাছে তাই এই ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না। মুন্নীর কাছ থেকে আমি তা নিলাম এবং সেদিনই সন্ধ্যায় তা ফজলুকে দিয়ে আসলাম। মুন্নী পাঠিয়েছে শুনে ফজলুর চোখ দু'টো ছলছল করে উঠলো, যেন এখনই সে কেঁদে ফেলবে।

নির্ধারিত তারিখে ফজলু দুবাই চলে গেলো। পরদিন কলেজে মুন্নী আমার কাছে জানতে চাইলো, ফজলু যাবার সময় তার দেওয়া শার্ট ও প্যন্টটা পরেছে কিনা। বললাম, 'হ্যাঁ।' আমার উত্তর শুনে মুন্নী আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না, চলে যেতে পা বাড়ালো। আমি ডাকলাম তাকে, সে আবার এগিয়ে এলো আমার সামনে। বললাম, 'তোমার দেওয়া শার্ট ও প্যান্টটাতে ফজলুকে রাজপুত্রের মতো লাগছিলো।' হঠাৎ কী হয়, মুন্নী হুহু করে কেঁদে উঠলো।

ফজলু টানা পাঁচ বছর দুবাইতে থাকে। এই সময়ে সে তার পরিবারের অভাব বলা যায় পুরোপুরি দূর করতে সক্ষম হয়। বাপদাদার ভিটিতে পাকা ঘরও উঠে যায় ততোদিনে। পাঁচ বছর পর দেশে আসে ফজলু। দেশে আসার একদিন পরেই আমার কাছে ছুটে এলো সে। মুন্নীর কথা জানতে চাইলো। ফজলুকে বলতে কষ্ট হচ্ছিলো, তবু ছয় মাস আগে মুন্নীর যে বিয়ে হয়ে গেছে, তা বলতেই হলো। শুনে আর কিছুই বললো না ফজলু, গাঢ় বিষাদের ছায়া নেমে এলো তার মুখাবয়বে।

সেবার ছয় মাস বাড়িতে ছিলো ফজলু। তারপর আবার চলে যায় দুবাইতে। এরপর প্রতি বছর দুয়েকের মাথায় ফজলু নিয়মিত দেশে আসে। এরমধ্যে ফজলুও বিয়ে করে। এই ক'দিন আগেও দেশে এসেছে সে। ফজলুর সেই বউ মুন্নীর মতো না-হলেও, মেয়েটিকেও ফজলু খুব ভালোবাসে।

ফজলু এখন আর দারিদ্র না, গ্রামে জমিজমাও কিনেছে অনেক। সেই সাথে চট্টগ্রাম শহরে গড়ে তুলেছে ছয় তলার সুদৃশ্য দালান। পোশাকআশাকে আভিজাত্যও নজরকাড়া। পরনে সবসময় দামি ব্রান্ডের শার্ট, প্যান্ট। গা থেকে ভেসে আসে দামি পারফিউমের সুবাস।

সেদিন দেখা হতেই, ফজলু হঠাৎ আবার পুরোনো প্রসঙ্গ টেনে আনলো। বললো, 'জানিস, মুন্নীর দেওয়া শার্ট ও প্যান্টটা এখনো সযত্নে আমার কাছে আছে।' তারপর একটু থেমে আবার বললো, 'আচ্ছা, মুন্নীর দেওয়া সেই শার্ট ও প্যান্ট, এতো বছর পরেও, এখনো যে আমি যত্ন করে রেখেছি, এমনি করে রাখবোও সারাজীবন--তা কি মুন্নী কোনোদিনও জানবে?'

আমি ফজলুর চোখের দিকে তাকালাম। এক জোড়া চোখ, যে চোখের তারায়, অনেক অনেক বছর পর, আমি যেন মুন্নীকে দেখতে পেলাম আবার। সেই মুন্নী, একদিন ফজলুর জন্য কেঁদে উঠেছিলো যে হঠাৎ! ভালোবাসার সেই সরল অপাপবিদ্ধ কান্না, যেন কোন দূরতম দেশ থেকে সেই কতোকাল পরে ফিরে এলো আবার।

মুন্নী, এখন কোথায় এবং কেমন আছে কে জানে! তার জন্য ফজলুর এই একাকার হাহাকার সে কী শুনতে পায়!   

Comments