একগুচ্ছ গোলাপ
শহিদুল ইসলাম আকাশ
সালটা ১৯৯৫। মুন্নীর বাবার বদলীর অর্ডার হয়েছে ক'দিন আগে। পুলিশের চাকরি করেন তিনি। এই চাকরিতে সবসময় বদলীর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তাও এখানে কীভাবে কীভাবে জানি চার বছরের মতো কাটাতে পারলেন তিনি। কাগজপত্র সব তৈরি, আগামীকালই চলে যেতে হবে। এবার তিনি বদলী হয়েছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে। বাবার সাথে মুন্নীদেরও ওখানে চলে যেতে হবে।
বাবার বদলীতে মুন্নীর মনটা ভীষণরকম খারাপ। আঠারোর তন্বী যুবতী মুন্নী। কলেজে একই ক্লাসের আজিমের সাথে মুন্নীর বন্ধুত্বটা এখন আর বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ নেই, মনে মনে সে আজিমকে ভালোবেসে এগিয়ে গেছে অনেকদূর। মনে মনেই। আজিমকে বলা হয়নি কখনো। মুন্নী জানে, আজিমও তার প্রতি...। এরমধ্যে হঠাৎ বাবার বদলীটা মুন্নীর সবকিছু কেমন যেন উলটপালট করে দিলো!
কাল মুন্নীরা চলে যাবে, এই কথা জানানো হয়নি আজিমকে। কী করে জানাবে সে তা! মুখে 'ভালোবাসি' বলা না-হলেও, ভালোবাসা আসন গেড়েছে দু'জনের মনেই। যাওয়ার আগে তাই অন্তত একবার চলে যাওয়ার কথাটা বলতেই হবে। বলে যাওয়াই উচিত।
বিকেলে ক্লাসের শেষে ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসলো দু'জনে। মুন্নী চুপচাপ। আজিম বললো, 'তুমি এতো বিষণ্ণ কেন হঠাৎ?' মুন্নী হাসতে চেষ্টা করলো, হাসতে সে পারলো না। কীভাবে আজিমকে ব্যাপারটা বলা যায়, তা মনে মনে রিহার্সাল করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই গুছিয়ে নিতে পারছে না সে। বললো, 'কই না তো। বিষণ্ণ লাগবে কেন!'
প্রসঙ্গ পাল্টে আজিম বললো, 'তোমার প্রিয় ফুল কী তা কখনোই জানা হয়নি। তোমার প্রিয় ফুল যেন কী?' আলাদা করে নিজের প্রিয় ফুল নিয়ে কখনোই ভাবেনি মুন্নী, বেলী ফুল ভালো লাগে তার, সেই সাথে যুঁই ফুলও পছন্দ করে সে। আজিমের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না তাই, কাল যে তাকে চলে যেতে হবে এই চেনা নগর ও চেনা মানুষ ছেড়ে--এই বিষাদ মনে মনে মুন্নীকে ব্যথিত করে তুললো বড়।
মুন্নীর উত্তরের অপেক্ষা না করে আজিম বললো, 'আমার প্রিয় ফুল কী জানো? গোলাপ। লাল গোলাপ।' তারপর একটু থেমে অন্যদিকে তাকিয়ে আজিম বললো, 'আচ্ছা মুন্নী তুমি কি কখনো আমার জন্য একগুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে নিয়ে আসবে? এসে, যে কথা তোমার মনে, মুখে আমাকে সেই কথাটা বলবে?'
আজিমের কথা শুনে মুন্নীর চোখদু'টো অশ্রুসিক্ত হলো, মুহূর্তেই সে কেঁদে উঠলো, বললো, 'আমরা কাল চলে যাচ্ছি আজিম!' মুন্নীর কথায় আজিম অবাক, যেন এমন আজগুবি কথা আজিম তার জীবনে কখনোই শুনেনি, 'চলে যাচ্ছো মানে! কোথায়...!'
মুন্নী তার বাবার বদলীর ব্যাপারটা বিশদ বললো। শুনে আজিমও হঠাৎ বিষণ্ণ হলো, বললো, 'কাল কখন?' মুন্নী বললো, 'সকালে। ন'টায়।'
উদ্বিগ্ন আজিম বললো, 'আমাদের কি তাহলে আর কোনোদিন দেখা হবে না!' আজিমের প্রশ্নের উত্তর মুন্নীর কাছে জানা নেই। সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। সবকিছু গুছাতে হবে, সকালে ভোরে উঠতে হবে। আজিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় মুন্নীর খুব ইচ্ছে হলো, আজিমকে একটু ছঁয়ে দিতে। ইচ্ছে হলেও ছুয়ে দিতে পারেনি সে। মানুষের ইচ্ছেগুলো এমন হয় কেন!
পুনশ্চ: এই গল্প লিখতে গিয়ে ভাবলাম, মুন্নী আজিমকে ছুঁয়ে দিক, ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছাকাছি হোক দু'জনে। চুমু খাক দু'জন দু'জনের ঠোঁটে। এমনটা হলে এই স্মৃতি তাদের সারাজীবন মনে থাকবে, কেউ ভুলবে না কোনোদিন। ভাবলেও, লিখতে বসে তা আমি লিখতে পারলাম না। একজন লেখক যখন লিখতে বসেন, তখন লেখক নিজেকে হতে হয় বড় অসহায়। তখন লেখকের ভেতরের অন্য কেউ সব লিখিয়ে নেয় হয়তো। মানুষের জীবনটা তো গল্প নয় জানি, জীবন কখনো গল্পের নিয়মে চলে না--এমনি করে ঠিক গল্পও জীবনের। তাহলে এমনটা লিখলেই কী এমন ক্ষতি হতো!
আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করছি এই মুহূর্তে যে, মুন্নী এখনো হয়তো গুচ্ছগুচ্ছ গোলাপ হাতে অপেক্ষায় থাকে আজিমের, চোখের জলে, ভালোবেসে। কিংবা আজিমও হয়তো এখনো ভাবে যে, এই বুঝি তার মুন্নী এলো! মুন্নীর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ, কী যে টকটকে লাল সে ফুল!
সালটা ১৯৯৫। মুন্নীর বাবার বদলীর অর্ডার হয়েছে ক'দিন আগে। পুলিশের চাকরি করেন তিনি। এই চাকরিতে সবসময় বদলীর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তাও এখানে কীভাবে কীভাবে জানি চার বছরের মতো কাটাতে পারলেন তিনি। কাগজপত্র সব তৈরি, আগামীকালই চলে যেতে হবে। এবার তিনি বদলী হয়েছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে। বাবার সাথে মুন্নীদেরও ওখানে চলে যেতে হবে।
বাবার বদলীতে মুন্নীর মনটা ভীষণরকম খারাপ। আঠারোর তন্বী যুবতী মুন্নী। কলেজে একই ক্লাসের আজিমের সাথে মুন্নীর বন্ধুত্বটা এখন আর বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ নেই, মনে মনে সে আজিমকে ভালোবেসে এগিয়ে গেছে অনেকদূর। মনে মনেই। আজিমকে বলা হয়নি কখনো। মুন্নী জানে, আজিমও তার প্রতি...। এরমধ্যে হঠাৎ বাবার বদলীটা মুন্নীর সবকিছু কেমন যেন উলটপালট করে দিলো!
কাল মুন্নীরা চলে যাবে, এই কথা জানানো হয়নি আজিমকে। কী করে জানাবে সে তা! মুখে 'ভালোবাসি' বলা না-হলেও, ভালোবাসা আসন গেড়েছে দু'জনের মনেই। যাওয়ার আগে তাই অন্তত একবার চলে যাওয়ার কথাটা বলতেই হবে। বলে যাওয়াই উচিত।
বিকেলে ক্লাসের শেষে ক্যান্টিনে মুখোমুখি বসলো দু'জনে। মুন্নী চুপচাপ। আজিম বললো, 'তুমি এতো বিষণ্ণ কেন হঠাৎ?' মুন্নী হাসতে চেষ্টা করলো, হাসতে সে পারলো না। কীভাবে আজিমকে ব্যাপারটা বলা যায়, তা মনে মনে রিহার্সাল করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই গুছিয়ে নিতে পারছে না সে। বললো, 'কই না তো। বিষণ্ণ লাগবে কেন!'
প্রসঙ্গ পাল্টে আজিম বললো, 'তোমার প্রিয় ফুল কী তা কখনোই জানা হয়নি। তোমার প্রিয় ফুল যেন কী?' আলাদা করে নিজের প্রিয় ফুল নিয়ে কখনোই ভাবেনি মুন্নী, বেলী ফুল ভালো লাগে তার, সেই সাথে যুঁই ফুলও পছন্দ করে সে। আজিমের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না তাই, কাল যে তাকে চলে যেতে হবে এই চেনা নগর ও চেনা মানুষ ছেড়ে--এই বিষাদ মনে মনে মুন্নীকে ব্যথিত করে তুললো বড়।
মুন্নীর উত্তরের অপেক্ষা না করে আজিম বললো, 'আমার প্রিয় ফুল কী জানো? গোলাপ। লাল গোলাপ।' তারপর একটু থেমে অন্যদিকে তাকিয়ে আজিম বললো, 'আচ্ছা মুন্নী তুমি কি কখনো আমার জন্য একগুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে নিয়ে আসবে? এসে, যে কথা তোমার মনে, মুখে আমাকে সেই কথাটা বলবে?'
আজিমের কথা শুনে মুন্নীর চোখদু'টো অশ্রুসিক্ত হলো, মুহূর্তেই সে কেঁদে উঠলো, বললো, 'আমরা কাল চলে যাচ্ছি আজিম!' মুন্নীর কথায় আজিম অবাক, যেন এমন আজগুবি কথা আজিম তার জীবনে কখনোই শুনেনি, 'চলে যাচ্ছো মানে! কোথায়...!'
মুন্নী তার বাবার বদলীর ব্যাপারটা বিশদ বললো। শুনে আজিমও হঠাৎ বিষণ্ণ হলো, বললো, 'কাল কখন?' মুন্নী বললো, 'সকালে। ন'টায়।'
উদ্বিগ্ন আজিম বললো, 'আমাদের কি তাহলে আর কোনোদিন দেখা হবে না!' আজিমের প্রশ্নের উত্তর মুন্নীর কাছে জানা নেই। সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। সবকিছু গুছাতে হবে, সকালে ভোরে উঠতে হবে। আজিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় মুন্নীর খুব ইচ্ছে হলো, আজিমকে একটু ছঁয়ে দিতে। ইচ্ছে হলেও ছুয়ে দিতে পারেনি সে। মানুষের ইচ্ছেগুলো এমন হয় কেন!
পুনশ্চ: এই গল্প লিখতে গিয়ে ভাবলাম, মুন্নী আজিমকে ছুঁয়ে দিক, ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছাকাছি হোক দু'জনে। চুমু খাক দু'জন দু'জনের ঠোঁটে। এমনটা হলে এই স্মৃতি তাদের সারাজীবন মনে থাকবে, কেউ ভুলবে না কোনোদিন। ভাবলেও, লিখতে বসে তা আমি লিখতে পারলাম না। একজন লেখক যখন লিখতে বসেন, তখন লেখক নিজেকে হতে হয় বড় অসহায়। তখন লেখকের ভেতরের অন্য কেউ সব লিখিয়ে নেয় হয়তো। মানুষের জীবনটা তো গল্প নয় জানি, জীবন কখনো গল্পের নিয়মে চলে না--এমনি করে ঠিক গল্পও জীবনের। তাহলে এমনটা লিখলেই কী এমন ক্ষতি হতো!
আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করছি এই মুহূর্তে যে, মুন্নী এখনো হয়তো গুচ্ছগুচ্ছ গোলাপ হাতে অপেক্ষায় থাকে আজিমের, চোখের জলে, ভালোবেসে। কিংবা আজিমও হয়তো এখনো ভাবে যে, এই বুঝি তার মুন্নী এলো! মুন্নীর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ, কী যে টকটকে লাল সে ফুল!
Comments
Post a Comment