পাহাড়ের মতো
শহিদুল ইসলাম আকাশ
লোকাল বাস। বাসের ভেতর সীটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর সংখ্যাও অনেক। তারউপর হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি। আমি অবশ্য সীট পেয়েছি। গাড়িতে ব্রেক হলেই, দাঁড়িয়ে-থাকা যাত্রীদের মধ্যে একজন আমার গায়ের উপর আছড়ে পড়ছেন, এটুকু বাদে তেমন বিব্রতকর কিছু মনে হলো না আমার। মন্দ লাগছিলো না।
যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ একজন আরেকজনের সাথে আলাপে মশগুল--তাঁদের পরিবারের কথা থেকে, ব্যবসাবাণিজ্য, দেশের রাজনীতি ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন--বাদ যাচ্ছে না কিছুই। আমার সামনের সীটে একজন প্রবাসী বসেছেন, সম্ভবত তিনি এর আগে কখনোই এমন লোকাল বাসে বসেননি, ছোট যানগুলোর ধর্মঘটের কারণে বাধ্য হয়ে তাঁকে এই গাড়িতে উঠতে হয়েছে হয়তো। মানুষটা বেজায় বিরক্ত, একটু পরপর বাসের ভেতরের সামনেপিছনে তাকাচ্ছেন আর কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে বলছেন, 'কী যে বিরক্তিকর সব মানুষ!' তাঁর ঠিক পাশের সীটের মধ্যবয়সী লোকটা তাঁর উদ্দেশে বললেন, 'বিরক্তিকর মানুষ কি শুধু বাসেই থাকে, বিমানেও কি থাকে না?'
আমার পাশের সীটে পঁচিশ-ছাব্বিশের এক তরুণ বসা। জানালার বাইরে তাকিয়ে হেডফোনে মোবাইল থেকে গান শুনছে সে। বাসের ভেতর এই অবিরাম কোলাহলের সাথে তার যেন কোনোই যোগ নেই। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, এই জাতীয় বাসের নিয়মিত যাত্রী সে। পরনে ঝকঝকে শার্টপ্যান্ট, হাতে গড়ি, সানগ্লাসটা বুকের মধ্যিখানে শার্টের সাথে ঝুলানো, পায়ের জুতোজোড়া নতুন না হলেও, পালিশ করা বলে নতুনের মতোই দেখাচ্ছে। গা থেকে ভেসে আসছে পারফিউমের কড়া সুগন্ধ। সে কি তার প্রিয় কোনো মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে? এই যুগে 'ডেটিং' বলে যাকে?
ছেলেটার দিকে খানিক পরপর এমন আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছিলাম, একটা সময় সে তা খেয়াল করে ফেললো। কান থেকে হেডফোনটা খুলে আমার দিকে তাকালো, হেসে বললো, 'আমাকে কিছু বলবেন মনে হয়।' বললাম, 'হুম।' সে বললো, 'জ্বি বলুন।'
আমিও জানালার বাইরে তাকালাম, তাকিয়ে থেকে বললাম, 'তুমি যে মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছো, সে কেমন? আই মিন দেখতেশুনতে...?'
ছেলেটা যেন এমন বিস্ময়কর কথা তার জীবনে কখনোই শুনেনি আগে। চোখ রীতিমত কপালে তুলে বললো, 'আপনি কীভাবে জানলেন!'
ছেলেটার বেশভূষা দেখে অনুমানে ঢিল ছুঁড়লাম, সেই ঢিল জায়গামতো লেগে যাওয়া কাকতালীয় হলেও, রহস্যময় হাসি দিয়ে বললাম, 'আমার ইএসপি ক্ষমতা আছে। চেহারা দেখে মানুষের অনেককিছুই বলতে পারি।'
আমার কথায় ছেলেটা বিভ্রান্ত হলো, চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কথায় কথায় বললো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়, এই প্রথম সেই মেয়েটার সাথে সামনাসামনি দেখা করতে যাচ্ছে সে। ছেলেটার মুখে সেই মেয়ের প্রশংসার অন্ত নেই। ছবিতে দেখেছে, ফোনে কথা হয়, নিয়মিত ভিডিও কলেও দেখা হয়। তার মতে মেয়েটা অসম্ভব রূপবতী, সাথে অসম্ভব গুণবতীও।
বাস থামার নির্দিষ্ট স্টেশনের আগে ছেলেটার গন্তব্য এসে গেলো। সে নামার সময় তার পিঠে হাত চাপড়ে বললাম, 'যাও। তোমাদের জন্য শুভকামনা রইলো।' ছেলেটা হেসে সামান্য এগিয়ে বাসের দরজা দিয়ে নেমে গেলো।
বাস চলছে। এতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে-থাকা আমারই বয়সী এক যাত্রী এখন আমার পাশের সীটে এসে বসেছেন। আমি বাসের জানালার বাইরে চোখ রাখলাম। দূরের সুউচ্চ বহুতল বাড়িগুলো একটার পর একটা অদৃশ্য হচ্ছে, ফাঁকেফাঁকে কিছু সবুজ বনানীও। তা দেখতে দেখতে সেই ছেলেটার কথা ভাবতে লাগলাম আবার এবং তার প্রেমেরও। ছেলেটা তার প্রিয়তমা মেয়েটার সাথে এই প্রথম সামনাসামনি দেখা হওয়ার পর তার আগের সেই উচ্ছ্বাস কি থাকবে? থাকলেও তার স্থায়ীত্ব কতোটুকু?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে-উঠা সম্পর্কগুলো কেমন জানি। অনেকটা পাহাড়ের মতো। একেকটা পাহাড় দূর থেকে দেখতে কতই না সুন্দর, কাছে গেলে সেই সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াতে হয়। পাওয়া কি হয়?
কায়মনোবাক্যে চাইলাম, এই ছেলেটার বেলায় যেন এমনটা না-হয়। কখনো; কোনোদিনও।
লোকাল বাস। বাসের ভেতর সীটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর সংখ্যাও অনেক। তারউপর হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি। আমি অবশ্য সীট পেয়েছি। গাড়িতে ব্রেক হলেই, দাঁড়িয়ে-থাকা যাত্রীদের মধ্যে একজন আমার গায়ের উপর আছড়ে পড়ছেন, এটুকু বাদে তেমন বিব্রতকর কিছু মনে হলো না আমার। মন্দ লাগছিলো না।
যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ একজন আরেকজনের সাথে আলাপে মশগুল--তাঁদের পরিবারের কথা থেকে, ব্যবসাবাণিজ্য, দেশের রাজনীতি ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন--বাদ যাচ্ছে না কিছুই। আমার সামনের সীটে একজন প্রবাসী বসেছেন, সম্ভবত তিনি এর আগে কখনোই এমন লোকাল বাসে বসেননি, ছোট যানগুলোর ধর্মঘটের কারণে বাধ্য হয়ে তাঁকে এই গাড়িতে উঠতে হয়েছে হয়তো। মানুষটা বেজায় বিরক্ত, একটু পরপর বাসের ভেতরের সামনেপিছনে তাকাচ্ছেন আর কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে বলছেন, 'কী যে বিরক্তিকর সব মানুষ!' তাঁর ঠিক পাশের সীটের মধ্যবয়সী লোকটা তাঁর উদ্দেশে বললেন, 'বিরক্তিকর মানুষ কি শুধু বাসেই থাকে, বিমানেও কি থাকে না?'
আমার পাশের সীটে পঁচিশ-ছাব্বিশের এক তরুণ বসা। জানালার বাইরে তাকিয়ে হেডফোনে মোবাইল থেকে গান শুনছে সে। বাসের ভেতর এই অবিরাম কোলাহলের সাথে তার যেন কোনোই যোগ নেই। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, এই জাতীয় বাসের নিয়মিত যাত্রী সে। পরনে ঝকঝকে শার্টপ্যান্ট, হাতে গড়ি, সানগ্লাসটা বুকের মধ্যিখানে শার্টের সাথে ঝুলানো, পায়ের জুতোজোড়া নতুন না হলেও, পালিশ করা বলে নতুনের মতোই দেখাচ্ছে। গা থেকে ভেসে আসছে পারফিউমের কড়া সুগন্ধ। সে কি তার প্রিয় কোনো মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে? এই যুগে 'ডেটিং' বলে যাকে?
ছেলেটার দিকে খানিক পরপর এমন আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছিলাম, একটা সময় সে তা খেয়াল করে ফেললো। কান থেকে হেডফোনটা খুলে আমার দিকে তাকালো, হেসে বললো, 'আমাকে কিছু বলবেন মনে হয়।' বললাম, 'হুম।' সে বললো, 'জ্বি বলুন।'
আমিও জানালার বাইরে তাকালাম, তাকিয়ে থেকে বললাম, 'তুমি যে মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছো, সে কেমন? আই মিন দেখতেশুনতে...?'
ছেলেটা যেন এমন বিস্ময়কর কথা তার জীবনে কখনোই শুনেনি আগে। চোখ রীতিমত কপালে তুলে বললো, 'আপনি কীভাবে জানলেন!'
ছেলেটার বেশভূষা দেখে অনুমানে ঢিল ছুঁড়লাম, সেই ঢিল জায়গামতো লেগে যাওয়া কাকতালীয় হলেও, রহস্যময় হাসি দিয়ে বললাম, 'আমার ইএসপি ক্ষমতা আছে। চেহারা দেখে মানুষের অনেককিছুই বলতে পারি।'
আমার কথায় ছেলেটা বিভ্রান্ত হলো, চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কথায় কথায় বললো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়, এই প্রথম সেই মেয়েটার সাথে সামনাসামনি দেখা করতে যাচ্ছে সে। ছেলেটার মুখে সেই মেয়ের প্রশংসার অন্ত নেই। ছবিতে দেখেছে, ফোনে কথা হয়, নিয়মিত ভিডিও কলেও দেখা হয়। তার মতে মেয়েটা অসম্ভব রূপবতী, সাথে অসম্ভব গুণবতীও।
বাস থামার নির্দিষ্ট স্টেশনের আগে ছেলেটার গন্তব্য এসে গেলো। সে নামার সময় তার পিঠে হাত চাপড়ে বললাম, 'যাও। তোমাদের জন্য শুভকামনা রইলো।' ছেলেটা হেসে সামান্য এগিয়ে বাসের দরজা দিয়ে নেমে গেলো।
বাস চলছে। এতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে-থাকা আমারই বয়সী এক যাত্রী এখন আমার পাশের সীটে এসে বসেছেন। আমি বাসের জানালার বাইরে চোখ রাখলাম। দূরের সুউচ্চ বহুতল বাড়িগুলো একটার পর একটা অদৃশ্য হচ্ছে, ফাঁকেফাঁকে কিছু সবুজ বনানীও। তা দেখতে দেখতে সেই ছেলেটার কথা ভাবতে লাগলাম আবার এবং তার প্রেমেরও। ছেলেটা তার প্রিয়তমা মেয়েটার সাথে এই প্রথম সামনাসামনি দেখা হওয়ার পর তার আগের সেই উচ্ছ্বাস কি থাকবে? থাকলেও তার স্থায়ীত্ব কতোটুকু?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে-উঠা সম্পর্কগুলো কেমন জানি। অনেকটা পাহাড়ের মতো। একেকটা পাহাড় দূর থেকে দেখতে কতই না সুন্দর, কাছে গেলে সেই সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াতে হয়। পাওয়া কি হয়?
কায়মনোবাক্যে চাইলাম, এই ছেলেটার বেলায় যেন এমনটা না-হয়। কখনো; কোনোদিনও।
Comments
Post a Comment