দুর্ভাগা প্রাণী


শহিদুল ইসলাম আকাশ

আজিজ সাহেবের স্ত্রী মারা গেছেন, বাদে আসর জানাজা।

আজিজ সাহেব তাঁর স্ত্রীর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে, কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রীর জন্য ক্ষমা চাইলেন সবার কাছে। স্ত্রীর সাথে কারো কোনোপ্রকার লেনদেন থাকলে তা নিঃসংকোচে তাঁকে জানাবার আহবান করলেন। সোমবার রাতে মেজবানের দাওয়াতও দিলেন উপস্থিত মুসল্লিদের সবাইকে।

জানাজায় একদম সামনের কাতারে দাঁড়িয়েছি আমি। আমার পাশে আব্দুল গফুর সাহেবও আছেন। গফুর সাহেব একটু পরপর নিজে নিজে বকবক করে যাচ্ছেন, যার সবই আজিজ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে। বলছেন, 'শালা, ধড়িবাজ!' 'শালা তোর চোখের পানিও নকল।' 'বউয়ের জন্য যেন কতো দরদ!'... 

গফুর সাহব এসব কথা এতো নিচু স্বরে বলছিলেন যে, অন্য কারো শুনার সাধ্য নেই। আমি একই কাতারে তাঁর খুব কাছে দাঁড়ানো বলে কিছুটা শুনতে পাচ্ছিলাম।

গফুর সাহেব থেমে থেমে হাসছিলেনও। স্ত্রীর মরদেহ সামনে রেখে আজিজ সাহেব কাঁদছেন, তাতে গফুর সাহেবের এতো খুশির কী আছে? 

আছে। এই দুইজন পরস্পরের কঠিন শত্রু। একজন-আরেকজনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার সংখ্যাও অসংখ্য। সেইসব মামলার হিসেব কষতে হলে কাগজকলম নিয়ে বসার মতো ব্যাপার। একজন-আরেকজনের হাতে শারীরিক  আক্রমণের শিকারও হতে হয়েছে একাধিকবার। 

তা সত্ত্বেও একজন মানুষ এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিচ্ছেন, জানাজায় এতোটা আক্রমণাত্মক ও উল্লাস কি মেনে নেওয়ার মতো? আমি আব্দুল গফুর সাহেবের এহেন বৈরিতা দেখে অবাক হলাম।

এর তিন মাস পরের কথা। এই আব্দুল গফুর সাহেবের পুত্র মারা গেলেন এবার। পুত্রের কোনো ধরণের অসুখবিসুখ ছিলো না, জোয়ান শক্তসামর্থ্য ছেলেটার হার্ট হঠাতই বেঁকে বসলো। সেই জানাজায়ও হাজির হলাম আমি।

এবার আমি প্রথম কাতারে দাঁড়াইনি যদিও, কাকতালীয় হলেও সত্যি যে, তিন মাস আগে যার স্ত্রীর জানাজায় আব্দুল গফুর সাহেব উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন, এবার আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সেই আজিজ সাহেবই। 

পুত্রের মরদেহের সামনে গফুর সাহেব কাঁদছেন, তাই দেখে আজিজ সাহেবকেও বেশ খুশিখুশি মনে হলো। দৃশ্য একই, কুশীলবের স্থানই পরিবর্তন হয়েছে শুধু। 

ইমাম সাহেব নামাজ শুরুর আগে, মৃতের জন্য জান্নাত প্রার্থনা করলেন। যাঁরা আরবীতে জানাজার নামাজের নিয়ত জানেন না, তাঁরা বাংলায় 'এই ইমামের পিছনে জানাজার নামাজ আদায় করছি' বলে নিয়ত বাঁধার আহবান জানালেন। 

কানের লতিতে আঙুল ছুঁয়ে নিয়ত বাঁধার আগে আমি একবার গফুর সাহেব ও একবার আজিজ সাহেবের দিকে তাকালাম, মনে মনে বললাম, সবাইকেই তার কৃতকর্মের দাম শোধ দিয়ে যেতেই হয়, এই জীবনেই। মানুষ বড় দুর্ভাগা প্রাণী, জেনেও এই সত্যটা তারা মনে রাখে না কেউ। কখনোই।   

Comments