পত্রমিতালী

শহিদুল ইসলাম আকাশ

পত্রমিতালীর কথা কার কার মনে আছে? একসময়ের এই একমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমিও যুক্ত ছিলাম। দেশের নানাপ্রান্ত থেকে কতো কতো মানুষ আমায় চিঠি লিখতো, তার ইয়ত্তা নেই।

প্রায় সব চিঠিই এখনো আমার কাছে বেশ যত্নে সংরক্ষিত আছে। তাঁদের সবার সাথে যোগাযোগ না-থাকলেও, এখনো সেই সব স্মৃতি আমার খুব মনে গেঁথে আছে। মনে রাখার অপরাধ ছাড়া আমি যে আর কোনো অপরাধ শিখিনি আজ অব্দি।

কয়েকজনের সাথে অবশ্য এখনো যোগাযোগ আছে।  কিন্তু তা চিঠিপত্রে নয়__ফোনে, ফেসবুকে। আজকাল কে আর কাকে চিঠি লিখে!

পুরোনো সেই চিঠিগুলো মাঝে মাঝে আমি নাড়াছাড়া করি। আমার কৈশোরের, প্রথম যৌবনের কতো কথা জড়িয়ে আছে এসব চিঠির পরতে পরতে__হাতে ছুঁয়ে আমি তার ঘ্রাণ নিই, হৃদয়ের উষ্ণতায়।

বিশেষ করে একজনের দেওয়া প্রতিটি চিঠি এখনো আমাকে খুব মুগ্ধ করে। সে একজন ছেলে না মেয়ে বলতে চাই না। তাকে আমি বন্ধু মেনেছিলাম, বন্ধুত্বে মেয়ে বা ছেলে বলে কিছু নেই__বন্ধু তো বন্ধুই।

সেই বন্ধুর একটি চিঠি কয়েকদিন ধরে আমি প্রায়ই পড়ছি। অনেক বছর ধরে তার সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই। সেই চিঠি যতোবার পড়ছি একটা প্রশ্ন বারবার বারবার মনে উঁকি দিচ্ছে।

বন্ধুর সেই চিঠির কথাও বলবো, তার আগে আমার এই পত্রমিতালী শুরুর সময়টা একটু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ফেসবুকে নিতান্ত অল্পবয়সী আমার কিছু বন্ধুও আছে, পত্রমিতালী বিষয়ে সেই বন্ধুরা অন্তত কিছুটা তো জানতে পারবে।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়েই পত্রিকায় প্রথম আমার লেখা ছাপা হয়, সেই সময়ের জনপ্রিয় দৈনিক 'আজকের কাগজে'। তখন টিভি বলতে ছিলো এক বিটিভিই। বিটিভিতে তখনকার জনপ্রিয় সিরিয়াল 'এরাবিয়ান নাইটস' যা আমরা 'আলিফ লায়লা' বলতাম__ওই সিরিয়ালে মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার করার ক্ষোভ জানিয়ে ছোট একটা চিঠি লিখেছিলাম সেই দৈনিকে। ছাপা হবে, ভাবিনি। ছাপাই হলো।

সেই শুরু। তারপর থেকে দেশের অনেক পত্রিকাতেই নিয়মিত লেখালেখি অব্যাহত থাকলো অনেকটা সময় জুড়েই। 'চিঠিপত্র', 'খোলা জানালা', 'মনের আয়না', 'এইসব কথামালা', 'ফুলকলিদের আসর'...পাঠকদের লেখার জন্য এমন কতো বিচিত্র বিচিত্র বিভাগ ছিলো সেই সময়ের দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাগুলোতে। আমি এসবে নিয়মিত লিখতাম।

বিভিন্ন বিষয়ের উপর চিঠি, মজার-বিচিত্র-রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখাগুলো পত্রিকায় ছাপা হলে, লেখার নিচে পুরো ঠিকানাটাও ছাপা হতো।  ছাপা হওয়ার পর সেই লেখা পড়ে কেউ কেউ লেখকের কাছে তাঁদের অনুভূতি জানিয়ে চিঠি লিখতেন।

আমার একেকটা লেখা পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয় আর আমার ঠিকানায় নিয়মিত আসতে থাকে নানাজনের চিঠি__অনেক অনেক। এতো চিঠি আসতো যে, কখনো একদিন দু'দিন কোনো চিঠি না-আসলে আমার নিজেরই ভালো লাগতো না।

অতোটুকু বয়সে আমার কাছে এতো চিঠি আসা দেখে পিয়ন তো একদিন আমাকে বলেই বসলেন, 'তোমার কাছে এতো চিঠি আসে! ঘটনাটা কী! তুমি করো কী?' জবাবে বলেছিলাম, 'পত্রিকায় লিখি।' পিয়ন আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকান, ভাবটা এমন যেন, আমি মিথ্যে বলছি; এতোটুকু পিচ্ছি সে কিনা পত্রিকায় লেখে!

কিছু চিঠির উত্তর দিতে দিতে কয়েকজনের সাথে নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম। এখন অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, ইচ্ছে হলেই একজন আরেকজনকে নিমেষেই দেখতে পারা যায়__তখন তো আর সে সুযোগ ছিলো না।

অদেখা, অজানা সেই সব মানুষগুলোকে না-দেখেও এক গভীর সম্পর্ক অনুভব করতাম।

অনেক বকবক করে ফেললাম। আমার সেই পত্রমিতার সেই চিঠির প্রসঙ্গে আসা যাক। তার সাথে দীর্ঘ চার বছরেরও অধিক পত্রযোগাযোগ ছিলো।

তার দেওয়া চিঠির মধ্যে গভীরে ছুঁয়ে যাওয়া সেই চিঠিটা হুবহু তুলে দিলাম:

'আকাশ,
কেমন আছো তুমি? তোমার লেখা কবিতার বই পেয়েছি। অসাধারণ অসাধারণ সব কবিতা। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। তুমি জানতে চেয়েছো আমি কাউকে ভালোবাসি কিনা। হ্যাঁ বাসি। যাকে আমি ভালোবাসি, তাকে এখনো চোখের দেখা দেখিনি, কথা হয়নি কখনো। শুধু জানি, সে আছে; আছে আমার সবটুকু জুড়ে।

'সে জোছনা খুব ভালোবাসে। জোছনায় হৃদয় খুঁজে বেড়ায়। মাঝে মাঝে স্বপ্নে তার সাথে দেখা হয়। তখন তাকে বলি, 'তুমি জোছনায় হৃদয় খুঁজো, মানুষের মধ্যেও যে একটা হৃদয় আছে, থাকে__এটা বুঝো না।' স্বপ্নের মানুষটিকেই কখনো কখনো বাস্তবের মানুষের চেয়েও সত্য মনে হয়।

'কখনো কখনো আকাশ ভেঙে অঝর জোছনা নেমে মাটির পৃথিবীকে স্বর্গ করে তুলে, সেই মুহূর্তে সব ছেড়েছুড়ে আমার তার কাছে ছুটে যেতে খুব ইচ্ছে করে। সে কি তখন দু'বাহু মেলে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলবো, 'এসো'?

'ভালো থেকো, মনে রেখো। ভুলতে হলে ভুলে যেও যত্ন করে।

ইতি: .........।'

একটা সময় হঠাৎ করে তার সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তার সে ভালোবাসার মানুষটির সাথে শেষ পর্যন্ত দেখা হয়েছে কিনা, জোছনা রাতে তারা যুগল জোছনাস্নানে স্নাত হতে পেরেছে কিনা__আমার জানা নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হতো।

তারপর কেটে যায় অনেক বছর। ততোদিনে পাল্টে গেছে জীবনের কতো কিছু, কতো কতো নিয়ম! ইচ্ছে হলেই যেখানে ফোনে খোঁজ নেওয়া যায়, ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ইন্সট্রাগ্রামের মতো মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়, সেখানে কিছুদিন আগে জাপানের টোকিও থেকে আমার ঠিকানায় একটি চিঠি আসে। প্রেরকের নাম নেই। সেই চিঠিটি ছিলো এমন:

'আকাশ সাহেব,
আমার পরিচয়টা দিলাম না। না-দিলেও আমার হাতের লেখা দেখে আমাকে যে আপনি চিনেছেন, তা আমি নিশ্চিত। দূরদেশে আছি, তবু আপনার মাথার ওপর যে আকাশ, আমারও মাথার ওপরে সেই একই আকাশ। সেই আকাশে যখন জোছনা নামে, জোছনার সেই হৃদয়ে এখন আমিও হৃদয় রাখতে শিখেছি। হৃদয়ের সেই উত্তাপ কি আপনি পান?

'তুমি বলতে পারছিলাম না, তাই আপনিই বললাম। অবাক হবার কিছু নেই। সময় তো কম গড়িয়ে যায়নি।

'ফেসবুকে নিয়মিতই আপনার লেখা পড়ি। আপনি আবার সার্চ দিয়ে আমাকে খুঁজতে যাবেন না। আমি আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। ফেসবুকে আমার নামটাও বেশ জটিল একটি ছদ্মনাম। ভালো থাকবেন।

'পুনশ্চ: আপনার জন্য একটি ধাঁধাঁ, আমি যাকে ভালোবাসি (বাসি বললাম, যেহেতু এখনো বাসি) তার নামের প্রথম ও শেষ অক্ষর একই__'শ'। নামটা কী বলতে পারবেন?

ইতি: সেই আমি।'

মনে মনে বললাম: প্রকৃতি তার সব রহস্য কখনো প্রকাশ করে না, মানুষও তো প্রকৃতিরই অংশ।

Comments