মিলনে ও বিরহে

শহিদুল ইসলাম আকাশ

মহড়ার পর্ব শেষ, নাটক যখন মঞ্চে উঠবে, তখনই দেখা গেলো বিপত্তি।

এক সপ্তাহ আগে থেকে সমস্তপ্রকার পরিকল্পনা করা ছিলো। এক কাজী অফিসে যথাসময়ে রুমানা আসবে, শফিক আগে থেকেই সেখানে থাকবে। দুই জন সাক্ষীও উপস্থিত রাখা হবে। রুমানার অন্যত্র বিয়ের সব ঠিকঠাক, দিনক্ষণও চূড়ান্ত। শফিক ও রুমানা পরস্পরকে ভালোবাসে, তাই তার আগেই কাজী অফিসে গিয়ে তাদের বিয়েটা সম্পন্ন করতে এই আয়োজন।

কিন্তু সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে শফিক, তখনো রুমানার দেখা নেই। একটু পরপর রুমানার মোবাইলে ফোন দিয়ে যেতে লাগলো সে, ফোন আর রিসিভ হয় না। ত্যক্তবিরক্ত শফিক পারে তো নিজের মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলে!

সাড়ে চারটার দিকে রুমানা অবশেষে আসে। রিকশায় করে এসেছে সে, রিকশাটা সামনে থামলো। শফিকের রাগ চরমে, বললো, 'এই আসার সময় হলো তোমার? ছয় ঘন্টা অপেক্ষায় রাখার পর!'

রুমানা ভাবলেশহীন। রিকাশার ভাড়া মিটিয়ে নামতে নামতে বললো, 'এতো উত্তেজিত হও কেন? ছয় ঘন্টা কি খুব বেশি সময়?'

রাগ এখনো শফিকের কণ্ঠে, বললো, 'খুব বেশি নয় বলছো! তুমি কি জানো পৃথিবীতে এমন অনেক কীটপতঙ্গ আছে, যাদের আয়ু ছয় ঘন্টারও কম?'

রুমানা বললো, 'জ্ঞানের কথা রাখো। তাছাড়া তুমি কীটপতঙ্গ নও, তুমি মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব।'

উত্তেজিত শফিকের জবাব, 'জ্ঞানের কথা কি তুমিও বলছো না?' তারপর বললো, 'বাদ দাও এসব। এসো, কাজী সাহেবকে সেই কখন থেকে অপেক্ষায় রেখেছি। চলো..।'

রুমানা নড়লো না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর বললো, 'আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এভাবে আমি বিয়ে করবো না।'

রুমানার এমন কথায় বিস্মিত শফিক। অনেকক্ষণ রুমানার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, 'এই সিদ্ধান্ত কখন নিলে আবার!'

রুমানা বললো, 'আজই নিয়েছি। এর বাইরে আর কিছু বলতে চাই না আমি। আমি এভাবে বিয়ে করবো না এটাই ফাইনাল।' বলেই একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে গেলো রুমানা। চলে গেলো সে। ঘটনার আকস্মিকতায় থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো শফিক।

এইসব তেরো বছর আগের ঘটনা। আমি এমন বিশদ বর্ণনা দিতে পারার কারণ হচ্ছে, সেদিন বিয়ের জন্য নির্ধারিত দু'জন সাক্ষীর একজন ছিলাম আমি। শফিক আমার ব্যবসার পার্টনার ছিলো, সেই সাথে সমবয়সীও। তার জোরাজুরিতে বিয়ের সাক্ষী হিসেবে আমাকে সেখানে হাজির হতেই হয়।

সেদিন কাজী অফিসে তাদের বিয়েটা না-হলেও, দুই পরিবারের সমঝোতায়, বিশেষ করে রুমানার একাগ্র চেষ্টায় পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় শেষতক তাদের।

আজ শফিক ও রুমানার বিয়েবার্ষিকী ছিলো। আমার দাওয়াত ছিলো, কাজের ব্যস্ততায় যেতে পারিনি। একটু আগে তারা স্বামীস্ত্রী কেক কাটছে এমন একটা ছবি পাঠায় আমার ইনবক্সে। তাদের পাশে পুতুলের মতো সুন্দর তাদের একমাত্র মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে ছবিতে। তারা তিন জনের মুখই হাসি হাসি, আনন্দে উজ্জ্বল। আমি ছবিটা জুম করে দেখলাম অনেকক্ষণ।

দেখতে দেখতে আমার হঠাৎ মনে হলো, ভালোবাসা সবসময় বিরহে উজ্জ্বল নয়, কখনোকখনো মিলনেও উজ্জ্বল হয়।   

Comments