তাসের ঘর
শহিদুল ইসলাম আকাশ
বন্ধুর স্ত্রীর সন্তান হবে। কয়েকদিন ধরে স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারখানায় বেশ দৌড়ঝাঁপ করছে; সন্তান প্রসবের তারিখ ঘনিয়ে এসেছে বলে জানায় সে।
তার বউকেও দেখিনি আমি। বিয়ের দিন সামান্য কিছু সময় ছিলাম অনুষ্ঠানে, বিয়ের পরেও তার বাসায় যাওয়া হয়নি, যদিও তার বাড়ির পাশ দিয়েই নিত্য আসা-যাওয়া আমার।
নির্দিষ্ট দিনে সন্তান হলো। আমাকে সাথে সাথে ফোন দিয়ে জানিয়েছে, বলেছে, ছেলে সন্তান হয়েছে। ফোনের অপর প্রান্তে সে তো বেজায় খুশি। এতোটাই উচ্ছ্বসিত সে যে, যেন পৃথিবীতে এই প্রথম কারো একটি পুত্রসন্তান হলো। সময় পেলে ক্লিনিকে গিয়ে দেখে আসতেও বললো। সময়টাই পাইনি বা পাওয়া হয়ে উঠেনি।
এরপর ছয় মাস কেটে গেলো। যাবো যাবো করেও তার বাসায় যাওয়া হয়ে উঠেনি। তার সাথে দেখাটেখা হয়, আমার ব্যস্ততা দেখে সেও আর কথাটথা বাড়ায় না। আমিও কেমন অদ্ভুত, একবার তার ছেলের কথা জানতে চাইলেই হয়! সাথে বউয়েরও!
তিন দিন আগে ফোন করেছিলো, কী একটা কাজে ফোন করা। সাথে গরম পাতিলে হাত লেগে ছেলের হাতের বেশ কিছু অংশ পুড়ে যাওয়ার কথাও জানালো সে। নিজের উপর রাগ হলো, একবার গিয়ে দেখে আসলেই হয়।
আজ সকালে সেই বন্ধুর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ভাবলাম, যাই একবার দেখে আসি। সে বাসায় আছে কিনা জানি না। বাসার দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লাম কয়েকবার। দেখি, সে আছে। দরজাটা সে-ই খুলে দিলো। আমাকে দেখে রীতিমত উচ্ছ্বসিত হলো। বললো, 'এতো ব্যস্ত থাকিস তুই, শালা, তোকে আজকাল খুঁজে পাওয়াও দায়।' আমি হাসলাম।
বললাম, 'তোর ছেলে দেখতে কার মতো হয়েছে রে, মা নাকি তার বাবার ভৌতিক চেহারাটা...?' আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে সে বললো, 'আমার চেহারা ভৌতিক, না?' বলে হাসতে হাসতে তেড়ে এলো সম্মুখে। সামনে এসেই থামলো, বললো, 'বস, আমার ছেলেকে দেখে যাবি।' বললাম, 'শুধু ছেলে? তোর বউ কোথায়?' সে জানালো, বউও আছে বাসায়।
একটু পরে ভেতরবাড়ি থেকে চা-নাস্তা নিয়ে আসা হলো। আমাদের চা খেতে খেতে তার বউও সন্তানকে কোলে নিয়ে এলো। পরীর মতো বউ, কোলের সন্তানও যেন কোনো দেবশিশু। দেখে বড় ভালো লাগলো।
তার বউ সালাম দিলো, আমি প্রতিউত্তর দিলাম। সে তার বউয়ের কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে আমার কোলে দিলো। বাচ্চাকাচ্চা কোলে নেওয়ার ব্যাপারে আমি বেশ অনভিজ্ঞ। তবু সৌজন্যতা রক্ষার্থে কোলে নিতেই হলো।
কোলে নিয়ে দেবশিশুর মতো অপূর্ব সুন্দর বন্ধুর সন্তানের দিকে চেয়ে গরম পাতিলে পুড়ে যাওয়া হাতের পোড়া অংশটা খুঁজতে লাগলাম। দেখলাম, ক্ষত শুকিয়েছে, তবু দাগটা এখনো অক্ষত রয়ে গেছে।
মনে মনে বললাম, সমস্ত জীবন ধরে যা শেখার, যতোটুকু শেখার, তা এমন নিজেরই হাত পুড়িয়ে, ভুল কুড়িয়ে শিখতে হয় সবাইকে। সেই ক্ষতও শুকায়, কিন্তু তার দাগটাও এমনি করে অক্ষতই থেকে যায় আজন্ম।
মানুষ কি আর চিরদিনের জন্য ইজারা নিয়েছে জীবন? জন্মের পরপরই 'মৃত্যু' নামের সত্যটা বড় হয়ে উঠে ক্রমশ। একদিন যখন হাওয়া উঠে, চারদিকে ঝড়ের মাতম, তখনই শুধু বুঝা যায় যে, কী মিথ্যে এই জগতসংসার! কী ঠুনকো এই তাসের ঘর__আমাদের সবার; সবারই।
বন্ধুর স্ত্রীর সন্তান হবে। কয়েকদিন ধরে স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারখানায় বেশ দৌড়ঝাঁপ করছে; সন্তান প্রসবের তারিখ ঘনিয়ে এসেছে বলে জানায় সে।
তার বউকেও দেখিনি আমি। বিয়ের দিন সামান্য কিছু সময় ছিলাম অনুষ্ঠানে, বিয়ের পরেও তার বাসায় যাওয়া হয়নি, যদিও তার বাড়ির পাশ দিয়েই নিত্য আসা-যাওয়া আমার।
নির্দিষ্ট দিনে সন্তান হলো। আমাকে সাথে সাথে ফোন দিয়ে জানিয়েছে, বলেছে, ছেলে সন্তান হয়েছে। ফোনের অপর প্রান্তে সে তো বেজায় খুশি। এতোটাই উচ্ছ্বসিত সে যে, যেন পৃথিবীতে এই প্রথম কারো একটি পুত্রসন্তান হলো। সময় পেলে ক্লিনিকে গিয়ে দেখে আসতেও বললো। সময়টাই পাইনি বা পাওয়া হয়ে উঠেনি।
এরপর ছয় মাস কেটে গেলো। যাবো যাবো করেও তার বাসায় যাওয়া হয়ে উঠেনি। তার সাথে দেখাটেখা হয়, আমার ব্যস্ততা দেখে সেও আর কথাটথা বাড়ায় না। আমিও কেমন অদ্ভুত, একবার তার ছেলের কথা জানতে চাইলেই হয়! সাথে বউয়েরও!
তিন দিন আগে ফোন করেছিলো, কী একটা কাজে ফোন করা। সাথে গরম পাতিলে হাত লেগে ছেলের হাতের বেশ কিছু অংশ পুড়ে যাওয়ার কথাও জানালো সে। নিজের উপর রাগ হলো, একবার গিয়ে দেখে আসলেই হয়।
আজ সকালে সেই বন্ধুর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ভাবলাম, যাই একবার দেখে আসি। সে বাসায় আছে কিনা জানি না। বাসার দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লাম কয়েকবার। দেখি, সে আছে। দরজাটা সে-ই খুলে দিলো। আমাকে দেখে রীতিমত উচ্ছ্বসিত হলো। বললো, 'এতো ব্যস্ত থাকিস তুই, শালা, তোকে আজকাল খুঁজে পাওয়াও দায়।' আমি হাসলাম।
বললাম, 'তোর ছেলে দেখতে কার মতো হয়েছে রে, মা নাকি তার বাবার ভৌতিক চেহারাটা...?' আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে সে বললো, 'আমার চেহারা ভৌতিক, না?' বলে হাসতে হাসতে তেড়ে এলো সম্মুখে। সামনে এসেই থামলো, বললো, 'বস, আমার ছেলেকে দেখে যাবি।' বললাম, 'শুধু ছেলে? তোর বউ কোথায়?' সে জানালো, বউও আছে বাসায়।
একটু পরে ভেতরবাড়ি থেকে চা-নাস্তা নিয়ে আসা হলো। আমাদের চা খেতে খেতে তার বউও সন্তানকে কোলে নিয়ে এলো। পরীর মতো বউ, কোলের সন্তানও যেন কোনো দেবশিশু। দেখে বড় ভালো লাগলো।
তার বউ সালাম দিলো, আমি প্রতিউত্তর দিলাম। সে তার বউয়ের কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে আমার কোলে দিলো। বাচ্চাকাচ্চা কোলে নেওয়ার ব্যাপারে আমি বেশ অনভিজ্ঞ। তবু সৌজন্যতা রক্ষার্থে কোলে নিতেই হলো।
কোলে নিয়ে দেবশিশুর মতো অপূর্ব সুন্দর বন্ধুর সন্তানের দিকে চেয়ে গরম পাতিলে পুড়ে যাওয়া হাতের পোড়া অংশটা খুঁজতে লাগলাম। দেখলাম, ক্ষত শুকিয়েছে, তবু দাগটা এখনো অক্ষত রয়ে গেছে।
মনে মনে বললাম, সমস্ত জীবন ধরে যা শেখার, যতোটুকু শেখার, তা এমন নিজেরই হাত পুড়িয়ে, ভুল কুড়িয়ে শিখতে হয় সবাইকে। সেই ক্ষতও শুকায়, কিন্তু তার দাগটাও এমনি করে অক্ষতই থেকে যায় আজন্ম।
মানুষ কি আর চিরদিনের জন্য ইজারা নিয়েছে জীবন? জন্মের পরপরই 'মৃত্যু' নামের সত্যটা বড় হয়ে উঠে ক্রমশ। একদিন যখন হাওয়া উঠে, চারদিকে ঝড়ের মাতম, তখনই শুধু বুঝা যায় যে, কী মিথ্যে এই জগতসংসার! কী ঠুনকো এই তাসের ঘর__আমাদের সবার; সবারই।


Comments
Post a Comment