ফার্স্ট বয় লাস্ট বয়
শহিদুল ইসলাম আকাশ
আজিজ মাস্টারের বুকে হঠাৎ হঠাৎ ব্যথা হচ্ছে ইদানীং। বড় ধরনের কোনো অসুখের আলামত নয়তো! ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুব জরুরি।
আজিজ মাস্টার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। চার বছর আগে অবসরে এসেছেন। অবসরের পর এককালীন পাওয়া টাকাগুলো দুই মেয়ের বিয়েতে খরচ হয়ে গেছে। এখন তাঁর সম্বল বলতে মাথাগোঁজার এক টুকরো বসতভিটেটুকু আর প্রতি মাসের পেনশনের সামান্য ক'টা টাকা। এই টাকাতেই স্ত্রীকে নিয়ে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় এখন তাঁকে।
গত দুই দিন ধরে তাঁর বুকের ব্যথাটা বাড়ছে ক্রমশ। মাসের মাঝামাঝি সময়, এই মাসের পেনশনের টাকার এখনো অবশ্য এগারো শ টাকা হাতে আছে। কিন্তু এই টাকাও যদি চিকিৎসাতে খরচ করতে হয় তাহলে মাসের বাদবাকি দিন তাঁরা স্বামীস্ত্রীকে না-খেয়ে থাকতে হবে। তাতেও আজিজ মাস্টার বিচলিত নন।
আজিজ মাস্টার খবর পেয়েছেন, তাঁর এক ছাত্র, মুজিব নাম, হৃদরোগের বড় ডাক্তার এখন। তার কাছে গেলে শিক্ষক হিসেবে নিশ্চয় ফি নেবে না মুজিব, উল্টো বহুদিন পর স্যারকে পেয়ে ওষুধপত্র কিনে দিতে চাইবে। মনে মনে তা ভেবে নিজেকে ভরসা দিলেন। ঠিক করলেন, তিনি তাঁর ছাত্র মুজিবের চেম্বারে যাবেন এবং তা আগামীকালই।
গেলেন। আজিজ মাস্টারের সিরিয়াল ৬৯। তিনি চেম্বারের অভ্যর্থনা কক্ষে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এরমধ্যে আজিজ মাস্টারের বুকের ব্যথাটা আবার তীব্রভাবে জানান দিলো হঠাৎ। বুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলেন তিনি। সিরিয়াল তখন সবে ২১, ৬৯ আসতে আরো অনেক দেরি! উপায় না-দেখে আজিজ মাস্টার এক কর্মচারীকে ডেকে ডাক্তার মুজিবের কাছে খবর পাঠালেন, মুজিবকে তার শিক্ষক আজিজ স্যার এসেছেন বললেই মুজিব হয়তো আগেভাগে ডেকে পাঠাবে। কিন্তু সেই কর্মচারী ফিরে এসে জানালো, 'ডাক্তার সাহেবকে বলেছি, তিনি কিছু বলেননি।'
বুকের ব্যথা নিয়ে আজিজ মাস্টার তাঁর সিরিয়ালের ডাক পড়ার অপেক্ষায় বসে রইলেন। দুই ঘন্টা পর আজিজ মাস্টারের সিরিয়াল এলো। তিনি ডাক্তার মুজিবের চেম্বারে ঢুকলেন। নিজের পরিচয় দিলেন, বললেন, 'আমি তোমার আজিজ স্যার।' ডাক্তার মুজিব বিরক্ত হলো, বললো, 'ওসব থাক। সমস্যার কথা বলুন।'
আজিজ মাস্টার তাঁর বুকের ব্যথার কথা বললেন। ডাক্তার মুজিব আজিজ মাস্টারের বুকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে দেখতে লাগলো---আজিজ মাস্টারের চোখ দেখলো, জিহ্বা দেখলো। তারপর একগাদা ঔষধ এবং সাথে অনেকগুলো টেস্ট দিলো। পরের সপ্তাহে রিপোর্ট দেখাতে বললো। আজিজ মাস্টার উঠতে যাবেন এমন সময় ডাক্তার মুজিব আজিজ মাস্টারকে অবাক করে দিয়ে বললো, 'ভিজিটটা...'। আজিজ মাস্টার তাঁর ছাত্র মুজিবের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন, একসময়ের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছেলেটার সাথে এই মুজিবের যেন আকাশ আর পাতালের তফাৎ।
আজিজ মাস্টার এক হাজার টাকার একটা নোট ডাক্তার মুজিবের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ডাক্তার মুজিব ৬০০ টাকা ভিজিট নিয়ে বাকি ৪০০ টাকা আজিজ মাস্টারকে ফেরত দিলো।
বাইরে এসে আজিজ মাস্টার বাসায় ফিরার গাড়ি খুঁজতে লাগলেন। একেকটা সিএনজি হাত দিয়ে ইশারা করে দাঁড় করান, তারা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি চেয়ে বসাতে তিনি গাড়িতে উঠেন না। বুকের ব্যথাটার কথা এতোক্ষণ মনে ছিলো না তাঁর, হঠাৎ আবার তা যেন জানান দিতে লাগলো। অন্য একটা সিএনজি সামনে ইশারা করলেন, গন্তব্য বলে উঠে গেলেন, এবার কেন জানি দরদাম করলেন না তিনি। ড্রাইভার ছেলেটাও আজিজ মাস্টারকে চেনে বলে মনে হলো। আজিজ মাস্টারকে দেখে সেই ড্রাইভার পরিচিতের মতো হাতে ধরে আজিজ মাস্টারকে গাড়িতে উঠালো।
গাড়িতে বসে আজিজ মাস্টার হিসেব কষতে লাগলেন--এখন হাতে আছে সব মিলিয়ে সাড়ে তিন শ টাকার মতো। এই টাকায় টেস্ট তো দূরের কথা, মুজিব যে ঔষধ লিখেছে, তাও মিলবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া মাসের এখনো অর্ধেক বাকি, খাওয়াপরার ব্যাপারটাও সামনে এসে দাঁড়ালো। কী যে করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না তিনি!
এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে এসে গাড়ি থামলো। আজিজ মাস্টার গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া দিতে যাবেন এমন সময় ড্রাইভার ছেলেটা বললো, 'এ কী স্যার। আমি আপনার ছাত্র রফিক। আমাকে চেনেননি? আমি আপনার কাছ থেকে ভাড়া নেবো না স্যার। ভাড়া দিতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না আমাকে।' আজিজ মাস্টার হা করে ড্রাইভার রফিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং এবার চিনলেনও ঠিকই। এই রফিক ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র ছিলো, সবার শেষে রোল থাকতো রফিকের।
আজিজ মাস্টার রফিকের পিঠে হাত রাখলেন। মুহূর্তেই আজিজ মাস্টারের দু'টি চোখ জলে ভরে উঠলো। ক্লাসের ফার্স্ট বয় মুজিবকে জীবনের ক্লাসে কী অবলীলায় হারিয়ে দিলো ক্লাসের লাস্ট বয় রফিক! আজিজ মাস্টারের চোখভর্তি জল, কিন্তু তাঁর ঠোঁটের রেখায় আনন্দময় হাসি।
রফিক আজিজ মাস্টারের হাত ধরে বাসার দিকে এগিয়ে দিতে লাগলো আজিজ মাস্টারকে। আশ্চর্য, একটু আগেও যে বুকের ব্যথাটা খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিলো, আজিজ মাস্টারের সেই ব্যথাটা যেন সেরে গেলো মুহূর্তেই, হঠাৎ!
আজিজ মাস্টারের বুকে হঠাৎ হঠাৎ ব্যথা হচ্ছে ইদানীং। বড় ধরনের কোনো অসুখের আলামত নয়তো! ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুব জরুরি।
আজিজ মাস্টার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। চার বছর আগে অবসরে এসেছেন। অবসরের পর এককালীন পাওয়া টাকাগুলো দুই মেয়ের বিয়েতে খরচ হয়ে গেছে। এখন তাঁর সম্বল বলতে মাথাগোঁজার এক টুকরো বসতভিটেটুকু আর প্রতি মাসের পেনশনের সামান্য ক'টা টাকা। এই টাকাতেই স্ত্রীকে নিয়ে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় এখন তাঁকে।
গত দুই দিন ধরে তাঁর বুকের ব্যথাটা বাড়ছে ক্রমশ। মাসের মাঝামাঝি সময়, এই মাসের পেনশনের টাকার এখনো অবশ্য এগারো শ টাকা হাতে আছে। কিন্তু এই টাকাও যদি চিকিৎসাতে খরচ করতে হয় তাহলে মাসের বাদবাকি দিন তাঁরা স্বামীস্ত্রীকে না-খেয়ে থাকতে হবে। তাতেও আজিজ মাস্টার বিচলিত নন।
আজিজ মাস্টার খবর পেয়েছেন, তাঁর এক ছাত্র, মুজিব নাম, হৃদরোগের বড় ডাক্তার এখন। তার কাছে গেলে শিক্ষক হিসেবে নিশ্চয় ফি নেবে না মুজিব, উল্টো বহুদিন পর স্যারকে পেয়ে ওষুধপত্র কিনে দিতে চাইবে। মনে মনে তা ভেবে নিজেকে ভরসা দিলেন। ঠিক করলেন, তিনি তাঁর ছাত্র মুজিবের চেম্বারে যাবেন এবং তা আগামীকালই।
গেলেন। আজিজ মাস্টারের সিরিয়াল ৬৯। তিনি চেম্বারের অভ্যর্থনা কক্ষে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এরমধ্যে আজিজ মাস্টারের বুকের ব্যথাটা আবার তীব্রভাবে জানান দিলো হঠাৎ। বুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলেন তিনি। সিরিয়াল তখন সবে ২১, ৬৯ আসতে আরো অনেক দেরি! উপায় না-দেখে আজিজ মাস্টার এক কর্মচারীকে ডেকে ডাক্তার মুজিবের কাছে খবর পাঠালেন, মুজিবকে তার শিক্ষক আজিজ স্যার এসেছেন বললেই মুজিব হয়তো আগেভাগে ডেকে পাঠাবে। কিন্তু সেই কর্মচারী ফিরে এসে জানালো, 'ডাক্তার সাহেবকে বলেছি, তিনি কিছু বলেননি।'
বুকের ব্যথা নিয়ে আজিজ মাস্টার তাঁর সিরিয়ালের ডাক পড়ার অপেক্ষায় বসে রইলেন। দুই ঘন্টা পর আজিজ মাস্টারের সিরিয়াল এলো। তিনি ডাক্তার মুজিবের চেম্বারে ঢুকলেন। নিজের পরিচয় দিলেন, বললেন, 'আমি তোমার আজিজ স্যার।' ডাক্তার মুজিব বিরক্ত হলো, বললো, 'ওসব থাক। সমস্যার কথা বলুন।'
আজিজ মাস্টার তাঁর বুকের ব্যথার কথা বললেন। ডাক্তার মুজিব আজিজ মাস্টারের বুকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে দেখতে লাগলো---আজিজ মাস্টারের চোখ দেখলো, জিহ্বা দেখলো। তারপর একগাদা ঔষধ এবং সাথে অনেকগুলো টেস্ট দিলো। পরের সপ্তাহে রিপোর্ট দেখাতে বললো। আজিজ মাস্টার উঠতে যাবেন এমন সময় ডাক্তার মুজিব আজিজ মাস্টারকে অবাক করে দিয়ে বললো, 'ভিজিটটা...'। আজিজ মাস্টার তাঁর ছাত্র মুজিবের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন, একসময়ের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছেলেটার সাথে এই মুজিবের যেন আকাশ আর পাতালের তফাৎ।
আজিজ মাস্টার এক হাজার টাকার একটা নোট ডাক্তার মুজিবের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ডাক্তার মুজিব ৬০০ টাকা ভিজিট নিয়ে বাকি ৪০০ টাকা আজিজ মাস্টারকে ফেরত দিলো।
বাইরে এসে আজিজ মাস্টার বাসায় ফিরার গাড়ি খুঁজতে লাগলেন। একেকটা সিএনজি হাত দিয়ে ইশারা করে দাঁড় করান, তারা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি চেয়ে বসাতে তিনি গাড়িতে উঠেন না। বুকের ব্যথাটার কথা এতোক্ষণ মনে ছিলো না তাঁর, হঠাৎ আবার তা যেন জানান দিতে লাগলো। অন্য একটা সিএনজি সামনে ইশারা করলেন, গন্তব্য বলে উঠে গেলেন, এবার কেন জানি দরদাম করলেন না তিনি। ড্রাইভার ছেলেটাও আজিজ মাস্টারকে চেনে বলে মনে হলো। আজিজ মাস্টারকে দেখে সেই ড্রাইভার পরিচিতের মতো হাতে ধরে আজিজ মাস্টারকে গাড়িতে উঠালো।
গাড়িতে বসে আজিজ মাস্টার হিসেব কষতে লাগলেন--এখন হাতে আছে সব মিলিয়ে সাড়ে তিন শ টাকার মতো। এই টাকায় টেস্ট তো দূরের কথা, মুজিব যে ঔষধ লিখেছে, তাও মিলবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া মাসের এখনো অর্ধেক বাকি, খাওয়াপরার ব্যাপারটাও সামনে এসে দাঁড়ালো। কী যে করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না তিনি!
এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে এসে গাড়ি থামলো। আজিজ মাস্টার গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া দিতে যাবেন এমন সময় ড্রাইভার ছেলেটা বললো, 'এ কী স্যার। আমি আপনার ছাত্র রফিক। আমাকে চেনেননি? আমি আপনার কাছ থেকে ভাড়া নেবো না স্যার। ভাড়া দিতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না আমাকে।' আজিজ মাস্টার হা করে ড্রাইভার রফিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং এবার চিনলেনও ঠিকই। এই রফিক ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র ছিলো, সবার শেষে রোল থাকতো রফিকের।
আজিজ মাস্টার রফিকের পিঠে হাত রাখলেন। মুহূর্তেই আজিজ মাস্টারের দু'টি চোখ জলে ভরে উঠলো। ক্লাসের ফার্স্ট বয় মুজিবকে জীবনের ক্লাসে কী অবলীলায় হারিয়ে দিলো ক্লাসের লাস্ট বয় রফিক! আজিজ মাস্টারের চোখভর্তি জল, কিন্তু তাঁর ঠোঁটের রেখায় আনন্দময় হাসি।
রফিক আজিজ মাস্টারের হাত ধরে বাসার দিকে এগিয়ে দিতে লাগলো আজিজ মাস্টারকে। আশ্চর্য, একটু আগেও যে বুকের ব্যথাটা খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিলো, আজিজ মাস্টারের সেই ব্যথাটা যেন সেরে গেলো মুহূর্তেই, হঠাৎ!
Comments
Post a Comment