সেই অনুভূতি

শহিদুল ইসলাম আকাশ


কল্পনায় নাদিয়ার সাথে কথা বলছি আর মনে মনে গল্প সাজিয়ে নিচ্ছি। নাদিয়া যেহেতু নেই, তাকে তাই কল্পনাতেই খুঁজে নেওয়া। একজন লেখকের কাছে সবচেয়ে বড় আশ্রয় তো তার কল্পনাই।

নাদিয়াকে নিয়ে একটা গল্প লেখার কথা প্রায়ই ভাবি। এই ভাবনা গত দুই বছর ধরেই আছে। কিন্তু লেখা আর হয়ে উঠে না। আজ যদি লিখতে পারি!

লিখতে যে আগেও অনেকবার বসিনি, তাও নয়। অনেকবারই বসেছি। যখনই বসি, লিখতে অস্বস্তি হয়। অস্বস্তির কারণও আছে, এখনো পর্যন্ত নাদিয়ার কয়েকটা ছবিই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, আর তার কণ্ঠের দুয়েকটা গান--তাও মোবাইলে। নাদিয়া মাঝেমাঝে স্বামীকে খালি গলায় গান গেয়ে শুনাতো, নাদিয়ার সেই গান মোবাইলে রেকর্ড করে রাখা হতো। গানগুলো এখনো যত্ন করে রেখেছে স্বামী সরোয়ার।

নাদিয়াকে সামনে থেকে দেখা আমার হয়নি কখনো, লিখতে বসলে তাই সঠিক বর্ণনা দেওয়া কষ্টসাধ্য। তবু কল্পনায় নিজের মতো করে নাদিয়াকে ভেবে নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু তাও ওই পর্যন্তই। লেখা আর এগোয় না। আজ যদি লিখতে পারি অবশেষে।

নাদিয়ার স্বামী সরোয়ারকে অবশ্য বেশ ভালোভাবেই জানি। আমার অবসরের সময়টাতে সরোয়ার আমার সান্নিধ্য চায়। দুইটা বছর ধরে এই সান্নিধ্য সে ছাড়েনি।

পাঁড় ভক্ত বলতে যা বোঝায়, সরোয়ার আমার লেখার এমনই ভক্ত। কথায়কথায় সে প্রায়ই নাদিয়াকে টেনে আনে। না বললেও বুঝি, হয়তো সে চায় যে, আমি তার নাদিয়াকে নিয়ে কিছু যদি লিখি। তার এই অপার আগ্রহ বুঝতে পেরে, নাদিয়াকে নিয়ে লিখবার ইচ্ছেটাও যায় না আমার। তাই তো নাদিয়াকে নিয়ে গল্প লেখার জন্য এতো মরিয়া আমিও।

নাদিয়াকে ভালোবেসে বিয়ে করে সরোয়ার। সম্পর্কের তিন বছর পর তারা পরস্পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। দুই পরিবার অমত থাকাতে পালিয়ে বিয়ে করতে হয় তাদের। বিয়ের পর একটা ভাড়া বাসায় দু'জনকে নতুন জীবন শুরু করতে হয়। রুটিরুজির জন্য সরোয়ার খুঁজে নেয় যৎসামান্য পুঁজির ব্যবসা।

সময়গুলো খুব দ্রুতই কেটে যাচ্ছিলো। ভালোবাসার যেমন কমতি ছিলো না তাদের, ছিলো না সুখেরও কমতি। এসব আমি সরোয়ারের কাছ থেকেই জেনেছি।

নাদিয়া আর এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। বিয়ের মাত্র দুই বছরের মাথায় মৃত্যু হয় তার। লিখতে বসে ঠিক করলাম, আমার গল্পে নাদিয়ার মৃত্যু হবে না। মৃত্যুর মতো ভয়াবহ ব্যাপার তাদের এই নিরবিচ্ছিন্ন প্রেমের যবনিকা করবে, একজন লেখক হয়েও এতোটা নিষ্ঠুর আমি হবো না। তাছাড়া গল্প তো জীবন নয়, এখানে মৃত্যু যেমন লেখা যায়, লেখা যায় জীবনের জয়গানও।

আজ লিখতে বসে কল্পনায় নাদিয়ার সাথে আমার নিম্নোক্ত কথা হলো:

নাদিয়া:সরোয়ার কি এখনো রাত জাগে?
আমি: জাগে হয়তো।
নাদিয়া: রাত জাগতে নিষেধ করবেন তাকে। আমি তো নেই, শেষে অসুখবিসুখ বাধালে কে দেখবে তাকে?
আমি: আচ্ছা বলবো।
নাদিয়া: সিগারেট কম খেতে বলবেন। বলবেন, সিগারেট যখন সে হাতে নেয়, তখন আমার খুব কষ্ট হতো তখন। এখনো হয়।
আমি: আচ্ছা, তাও বলবো।
নাদিয়া: আরেকটা কথা...
আমি: বলো...
নাদিয়া: সরোয়ারকে বলবেন...(নাদিয়া চুপচাপ)
আমি: কী বলতে হবে, বলো।
নাদিয়া: বলবেন, আমি তাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। এখনো।

বলতে বলতে নাদিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। নাদিয়া কি কাঁদছে!

নাদিয়ার সেই কান্নার শব্দ রহস্যময় কোনো জগত থেকে স্পষ্ট যেন শুনতে পাচ্ছি আমি। আমি গল্পের প্রথম লাইনটা লিখতে শুরু করলাম। লিখলাম--'নাদিয়া নাম মেয়েটার। গ্রিক পুরাণের রানীদের মতো অপুর্ব রূপবতী নারী...'

নাদিয়াকে নিয়ে গল্পটা আমি এগিয়ে নিতে লাগলাম। অনেকটা লিখে একবার থামলাম। আরেকবার কল্পনায় তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করা যায়। নাদিয়ার কাছ থেকে জেনে নেওয়ার খুব ইচ্ছে যে, প্রেমই কি একমাত্র অনুভূতি, যা মৃত্যুর পরেও মানুষকে ছেড়ে যায় না?

Comments