পুতুলের মন
শহিদুল ইসলাম আকাশ
আমার বাসার ডানদিকে কিছুদূর এগোলে পুর্বদিকে একটা গলি পড়ে। কাছাকাছি হলেও, ওই গলিতে কখনো যাই না আমি। শুনেছি গলিটাতে নাকি সকালসন্ধ্যা 'খারাপ' মেয়েদের আনাগোনা থাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তারা খদ্দের জোটায়, তারপর নিয়ে যায় পাশের কোনো আবাসিক হোটেল বা বোর্ডিংয়ে। এই কারণেই ওই গলি এড়িয়ে যাই, পাছে পরিচিত কেউ দেখে কী না কী ভেবে বসে!
তখন আমি অনেকটা নিজ উদ্যোগে একটা পাক্ষিক পত্রিকা বের করি। প্রকাশক ও সম্পাদক আমি নিজেই। কদাচিৎ দুয়েকটা বিজ্ঞাপন যদিও পাই, তার টাকাও ঠিকঠাকমতো পাওয়া হয় না প্রায়ই। শখের নাম লোকসানের মতো ব্যাপার।
এরমধ্যে একটা বহুজাতিক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করলে, তারা মোটামুটি অংকের টাকার বিজ্ঞাপন দেওয়ার আশ্বাস দেয় এবং সাথে শর্তও জুড়ে দেয়। শর্ত হলো, তাদের প্রোডাক্ট 'কনডমে'র বিজ্ঞাপন দেবে, তবে কভারস্টোরি হতে হবে 'পতিতা'দের নিয়ে। কভারস্টোরির প্রতি পাতায় ছোট করে কনডমের রঙিন বিজ্ঞাপন ছাপতে হবে। (পতিতা শব্দটাতে আমার আপত্তি আছে, তাই উদ্ধৃতি চিহ্ন দিতে হলো।)
আমতা আমতা করে রাজি হয়ে গেলাম। মন্দ কী, যৌনপল্লীতে রোগবালাইয়ের বিরুদ্ধে কনডমের মতো বিষয়টা সচেতনতা বাড়াবে, এমন প্রবোধও দিলাম নিজেকে নিজে। তাছাড়া যৌনপল্লী বাসার কাছেই তো আছে, চিন্তা কী!
তরুণ এক সাংবাদিককে নিয়ে নেমে গেলাম পত্রিকার পরের সংখ্যা প্রকাশের কাজে। একদিন সন্ধ্যার পরে বাসার অদূরে সেই রহস্যময় গলিটাতে ঢুঁ দিলাম। খানিকটা ভয়, অনেকটা সম্মানের চিন্তা মাথায় রেখে। কেউ দেখলে কী যে ভাবে, কে জানে!
আমাদের দেখে, গাঢ় সাজগোছ করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবতী ডেকে উঠলো, বললো, 'যাইবেন?' আমরা পরস্পরের দিকে মুখ চেয়ে বললাম, 'কোথায় যাবো?' হাসলো মেয়েটা, বললো, 'ওমা, কন কি? কোথায় যাইবেন আপনেরা জানেন না?' আর এক মুহূর্তও না ভেবে মেয়েটাকে বললাম, 'চলো।'
সামনে হাঁটছে সে, আমরা দু'জন তার পিছু পিছু যাচ্ছি। যেতে যেতে মেয়েটা বললো, 'আমি ছাড়াও আরো সাতজন আছে আমাগো বোর্ডিংয়ে। আমার চেয়েও সুন্দরও আছে। যেটা পছন্দ হইবো, খালি ইশারা করবেন। ব্যস।' এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু থামলো সে, তারপর বললো, 'তয় আজকে রুনারে পাইবেন না। আমাগো মইধ্যে সেই সবথে সুন্দরী।'
হাঁটতে হাঁটতে আমি বললাম, 'কেন? সে কি অসুস্থ?' শুনে হেসে উঠলো মেয়েটা, বললো, 'আমাগো আবার সুখঅসুখ আছে নাকি? রুনা সাপ্তায় একদিন কাস্টমার লয় না, আইজ সেই দিন।'
আমি কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললাম, 'সপ্তাহে একদিন কী করে তাহলে সে? কাস্টমারই বা নেয় না কেন?' মেয়েটা বললো, 'সেটা আমি ক্যামনে কই! এই দিন রুনা ঘরের দরজাজানালা বন্ধ কইরা ঘরের ভেতর বইসা থাকে। ক্যান বইসা থাকে, সে-ই জানে।'
পত্রিকার জন্য কভারস্টোরি করার চিন্তা ভুলে গেলাম আমি। কেন জানি না আমার ভাবনায় এসে পড়লো রুনা নামের মেয়েটা। সপ্তাহের একটা দিন সে দরজাবন্ধ ঘরে থাকবে কেন!
বোর্ডিংয়ে ঢুকেই, রুনা মেয়েটার কথা জানতে চাইলাম আগে। কোন রুমে আছে সে? আমাদের নিয়ে আসা মেয়েটা আঙুল উঁচিয়ে সামনে বামে একটা রুম দেখালো। আমি আর আমার সহযোগী সাংবাদিক দু'জন এগিয়ে গেলাম সেদিকে। দরজায় কড়া নাড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুললো। খুলতেই দেখলাম, আমার সামনে যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, 'তুমিই কি রুনা?' বিরক্তি নিয়ে বললো, 'জি। আপনারা আজ যান, আসতে ইচ্ছে হলে আগামীকাল আসবেন।'
রুনার কথা শুনে মনে হলো সে লেখাপড়া জানা মেয়ে। উচ্চারণ খুব শুদ্ধ। বললাম, 'আমরা সাংবাদিক। তোমাদের জীবনযাপন নিয়ে আমরা একটা বড় লেখা লিখতে চাই। তাই আসা।'
রুনা আমাদের দু'জনের দিকে কয়েক পলক তাকালো। তারপর আমাকে ইশারা করে বললো, 'আপনি একজন আসুন।' আমার সহযোগী সাংবাদিক তাতে সায় দিলো এবং সে সরে গেলো।
রুমে ঢুকতেই, রুনা দরজা বন্ধ করতে হবে কিনা জানতে চাইলো। বললাম, 'খোলাই থাক।' রুমের এক কোণায় খাটে বসতে বসতে সে বললো, 'এই কাজে থাকতে থাকতে আমরা মানুষের চোখ পড়তে পারি। আপনার সাথে আসা ওনাকে রুমে ঢুকতে বলিনি কেন জানেন? ওনার চোখ কেমন জানি, এক ধরনের নষ্টামি আছে তাতে। কিন্তু আপনার চোখে কোনো ধরনের পাপ নেই।'
খাটের পাশে রাখা একটা সিংগেল সোফায় বসলাম আমি। রুনা বললো, 'তা কী লিখবেন আমাকে নিয়ে? কেমন করে এই লাইনে আসলাম, কতোদিন হয়--এইসব?' আমি দুই দিকে মাথা নাড়লাম, বললাম, 'না। শুনেছি তুমি সপ্তাহে একদিন খদ্দের নাও না। কেন?'
রুনা খিলখিল করে বাচ্চামেয়ের মতো হেসে উঠলো, বললো, 'জেনে কী করবেন?' বললাম, কিছুই করবো না, 'জানার খুব আগ্রহ হলো, তাই।'
রুনার সহাস্যমুখ মুখ কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে গেলো হঠাৎ। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, 'অনেকদিন আগে এই দিনে কোনো এক প্রেমিক পুরুষ আমার হাতে হাত রেখেছিলো। সেই প্রথম এবং সে-ই শেষ প্রেমময় স্পর্শ আমার।'
সেই পুরুষ এখন কোথায়? নেই কি? এসব জানার সুযোগ দিলো না রুনা। আমার দিকে তাকালো। তাকাতেই দেখি তার দু'টি চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তখন। মেয়েটা কাঁদছে! কবেকার কোন এক প্রেমিক পুরুষের সামান্য প্রেমময় স্পর্শের জন্য আজও কেন এই তৃষিত প্রতীক্ষা তার!
যে সুন্দর, সে সবসময় সব অবস্থাতেই সুন্দর। অশ্রুসিক্ত রুনাকেও যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছিলো--অপরূপ কোনো পুতুল যেন। যে পুতুলের শুধু শরীর না, আশ্চর্যরকম সুন্দর একটা মনও আছে।
রুনা মেয়েটার অশ্রুভেজা দু'টি চোখের গভীরে, সেই মনটাকে তখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি।
আমার বাসার ডানদিকে কিছুদূর এগোলে পুর্বদিকে একটা গলি পড়ে। কাছাকাছি হলেও, ওই গলিতে কখনো যাই না আমি। শুনেছি গলিটাতে নাকি সকালসন্ধ্যা 'খারাপ' মেয়েদের আনাগোনা থাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তারা খদ্দের জোটায়, তারপর নিয়ে যায় পাশের কোনো আবাসিক হোটেল বা বোর্ডিংয়ে। এই কারণেই ওই গলি এড়িয়ে যাই, পাছে পরিচিত কেউ দেখে কী না কী ভেবে বসে!
তখন আমি অনেকটা নিজ উদ্যোগে একটা পাক্ষিক পত্রিকা বের করি। প্রকাশক ও সম্পাদক আমি নিজেই। কদাচিৎ দুয়েকটা বিজ্ঞাপন যদিও পাই, তার টাকাও ঠিকঠাকমতো পাওয়া হয় না প্রায়ই। শখের নাম লোকসানের মতো ব্যাপার।
এরমধ্যে একটা বহুজাতিক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করলে, তারা মোটামুটি অংকের টাকার বিজ্ঞাপন দেওয়ার আশ্বাস দেয় এবং সাথে শর্তও জুড়ে দেয়। শর্ত হলো, তাদের প্রোডাক্ট 'কনডমে'র বিজ্ঞাপন দেবে, তবে কভারস্টোরি হতে হবে 'পতিতা'দের নিয়ে। কভারস্টোরির প্রতি পাতায় ছোট করে কনডমের রঙিন বিজ্ঞাপন ছাপতে হবে। (পতিতা শব্দটাতে আমার আপত্তি আছে, তাই উদ্ধৃতি চিহ্ন দিতে হলো।)
আমতা আমতা করে রাজি হয়ে গেলাম। মন্দ কী, যৌনপল্লীতে রোগবালাইয়ের বিরুদ্ধে কনডমের মতো বিষয়টা সচেতনতা বাড়াবে, এমন প্রবোধও দিলাম নিজেকে নিজে। তাছাড়া যৌনপল্লী বাসার কাছেই তো আছে, চিন্তা কী!
তরুণ এক সাংবাদিককে নিয়ে নেমে গেলাম পত্রিকার পরের সংখ্যা প্রকাশের কাজে। একদিন সন্ধ্যার পরে বাসার অদূরে সেই রহস্যময় গলিটাতে ঢুঁ দিলাম। খানিকটা ভয়, অনেকটা সম্মানের চিন্তা মাথায় রেখে। কেউ দেখলে কী যে ভাবে, কে জানে!
আমাদের দেখে, গাঢ় সাজগোছ করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবতী ডেকে উঠলো, বললো, 'যাইবেন?' আমরা পরস্পরের দিকে মুখ চেয়ে বললাম, 'কোথায় যাবো?' হাসলো মেয়েটা, বললো, 'ওমা, কন কি? কোথায় যাইবেন আপনেরা জানেন না?' আর এক মুহূর্তও না ভেবে মেয়েটাকে বললাম, 'চলো।'
সামনে হাঁটছে সে, আমরা দু'জন তার পিছু পিছু যাচ্ছি। যেতে যেতে মেয়েটা বললো, 'আমি ছাড়াও আরো সাতজন আছে আমাগো বোর্ডিংয়ে। আমার চেয়েও সুন্দরও আছে। যেটা পছন্দ হইবো, খালি ইশারা করবেন। ব্যস।' এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু থামলো সে, তারপর বললো, 'তয় আজকে রুনারে পাইবেন না। আমাগো মইধ্যে সেই সবথে সুন্দরী।'
হাঁটতে হাঁটতে আমি বললাম, 'কেন? সে কি অসুস্থ?' শুনে হেসে উঠলো মেয়েটা, বললো, 'আমাগো আবার সুখঅসুখ আছে নাকি? রুনা সাপ্তায় একদিন কাস্টমার লয় না, আইজ সেই দিন।'
আমি কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললাম, 'সপ্তাহে একদিন কী করে তাহলে সে? কাস্টমারই বা নেয় না কেন?' মেয়েটা বললো, 'সেটা আমি ক্যামনে কই! এই দিন রুনা ঘরের দরজাজানালা বন্ধ কইরা ঘরের ভেতর বইসা থাকে। ক্যান বইসা থাকে, সে-ই জানে।'
পত্রিকার জন্য কভারস্টোরি করার চিন্তা ভুলে গেলাম আমি। কেন জানি না আমার ভাবনায় এসে পড়লো রুনা নামের মেয়েটা। সপ্তাহের একটা দিন সে দরজাবন্ধ ঘরে থাকবে কেন!
বোর্ডিংয়ে ঢুকেই, রুনা মেয়েটার কথা জানতে চাইলাম আগে। কোন রুমে আছে সে? আমাদের নিয়ে আসা মেয়েটা আঙুল উঁচিয়ে সামনে বামে একটা রুম দেখালো। আমি আর আমার সহযোগী সাংবাদিক দু'জন এগিয়ে গেলাম সেদিকে। দরজায় কড়া নাড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুললো। খুলতেই দেখলাম, আমার সামনে যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, 'তুমিই কি রুনা?' বিরক্তি নিয়ে বললো, 'জি। আপনারা আজ যান, আসতে ইচ্ছে হলে আগামীকাল আসবেন।'
রুনার কথা শুনে মনে হলো সে লেখাপড়া জানা মেয়ে। উচ্চারণ খুব শুদ্ধ। বললাম, 'আমরা সাংবাদিক। তোমাদের জীবনযাপন নিয়ে আমরা একটা বড় লেখা লিখতে চাই। তাই আসা।'
রুনা আমাদের দু'জনের দিকে কয়েক পলক তাকালো। তারপর আমাকে ইশারা করে বললো, 'আপনি একজন আসুন।' আমার সহযোগী সাংবাদিক তাতে সায় দিলো এবং সে সরে গেলো।
রুমে ঢুকতেই, রুনা দরজা বন্ধ করতে হবে কিনা জানতে চাইলো। বললাম, 'খোলাই থাক।' রুমের এক কোণায় খাটে বসতে বসতে সে বললো, 'এই কাজে থাকতে থাকতে আমরা মানুষের চোখ পড়তে পারি। আপনার সাথে আসা ওনাকে রুমে ঢুকতে বলিনি কেন জানেন? ওনার চোখ কেমন জানি, এক ধরনের নষ্টামি আছে তাতে। কিন্তু আপনার চোখে কোনো ধরনের পাপ নেই।'
খাটের পাশে রাখা একটা সিংগেল সোফায় বসলাম আমি। রুনা বললো, 'তা কী লিখবেন আমাকে নিয়ে? কেমন করে এই লাইনে আসলাম, কতোদিন হয়--এইসব?' আমি দুই দিকে মাথা নাড়লাম, বললাম, 'না। শুনেছি তুমি সপ্তাহে একদিন খদ্দের নাও না। কেন?'
রুনা খিলখিল করে বাচ্চামেয়ের মতো হেসে উঠলো, বললো, 'জেনে কী করবেন?' বললাম, কিছুই করবো না, 'জানার খুব আগ্রহ হলো, তাই।'
রুনার সহাস্যমুখ মুখ কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে গেলো হঠাৎ। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, 'অনেকদিন আগে এই দিনে কোনো এক প্রেমিক পুরুষ আমার হাতে হাত রেখেছিলো। সেই প্রথম এবং সে-ই শেষ প্রেমময় স্পর্শ আমার।'
সেই পুরুষ এখন কোথায়? নেই কি? এসব জানার সুযোগ দিলো না রুনা। আমার দিকে তাকালো। তাকাতেই দেখি তার দু'টি চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তখন। মেয়েটা কাঁদছে! কবেকার কোন এক প্রেমিক পুরুষের সামান্য প্রেমময় স্পর্শের জন্য আজও কেন এই তৃষিত প্রতীক্ষা তার!
যে সুন্দর, সে সবসময় সব অবস্থাতেই সুন্দর। অশ্রুসিক্ত রুনাকেও যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছিলো--অপরূপ কোনো পুতুল যেন। যে পুতুলের শুধু শরীর না, আশ্চর্যরকম সুন্দর একটা মনও আছে।
রুনা মেয়েটার অশ্রুভেজা দু'টি চোখের গভীরে, সেই মনটাকে তখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি।
Comments
Post a Comment