ছোটবাবু

শহিদুল ইসলাম আকাশ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা' পড়ছি আবার। এই একটি উপন্যাস আগেও আমি অসংখ্যবার পড়েছি। যতোবার পড়ি, প্রতিবারই আচ্ছন্ন হই, এর আবেদন কমে না কখনো আমার কাছে। ছোটবাবু, পরানের বউ, বিন্দু, কুমুদ, সেনদিদি, যামিনী কবিরাজ--গল্পের চরিত্রগুলো গল্প মনে হয় না, মনে হয় রক্তমাংসেরই। আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাসের একটি এটি।

বিশেষ করে ছোটবাবু, যার নাম শশী ডাক্তার, আর পরানের বউ অর্থাৎ কুসুম নাম যার--এই দুই প্রধান চরিত্রের কথা না-বললেই নয়। যৌবনের শুরুতে কুসুম আমাকে যে কতোখানি মুগ্ধ করে রেখেছিলো, তা কী করে বুঝাই?

এই উপন্যাসে যখন কুসুম আর শশীর প্রসঙ্গ আসে, তখন পড়তে পড়তে শিহরিত হতাম। কোনো এক অবাক করা জোছনা রাতে কুসুম যখন তার 'ছোটবাবু' শশী ডাক্তারকে বলে, 'এমন জোছনায় আপনার সাথে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ছোটবাবু', তখন মনে মনে নিজেকে শশীর জায়গায় বসিয়ে নিতাম আমি। পরানের বউ হতো আমারই কুসুম।

'কুসুম' নিয়ে মজার এক অভিজ্ঞতার কথা বলি। ঘটনাটা আমার স্ত্রীর সাথে। আমরা প্রেম করে বিয়ে করিনি। পারিবারিক পছন্দের বিয়ে ছিলো আমাদের। বিয়ের পর প্রথম দেখাতেই আমার স্ত্রীকে যখন প্রথম বললাম, 'কুসুম, কেমন আছো তুমি?' তখন সে চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকালো, তার দু'চোখ জুড়ে সন্দেহের ধুম্রজাল। কারণ তার নাম কুসুম না, কহিনুর।

আমার কথা শুনে সে কেঁদেকেটে অস্থির, বললো, 'তোমার মনে এই ছিলো? কুসুমটা কে? তুমি সেই কুসুমকেই বিয়ে করলে পারতে।'

সেদিন ঘটনার আকস্মিকতায় আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। কী বলতে কী বলে ফেললাম! যতোই আমি আমার স্ত্রীকে বুঝাই যে, কুসুম নামের কেউ আমার জীবনে ছিলো না, নেইও--তবু সে নাছোড়, বলে, 'বললেই হলো, অবশ্যই আছে। না-হলে হঠাৎ তুমি এই নাম উচ্চারণ করবে কেন!' কিন্তু কেন জানি সেদিন বলতে পারিনি, এই কুসুম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের একটি চরিত্র, শশী ডাক্তার হয়ে আমিও যার প্রেমে পড়েছি।

এখন আমরা দুই সন্তানের জনক ও জননী। দেখতে দেখতে সময়গুলো কতো দ্রুতই না কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো! এরপর অনবধানেও আমি তাকে 'কুসুম' 'কুসুম' বলে ডাকিনি আর। হয়তো জীবিকার বিরামহীন ঘোড়দৌড়ে আমার ভেতরের শশী ডাক্তারই ঘুমিয়ে গেছে, আমারই অলক্ষ্যে।

হয়তো সে দুঃখ পাবে বলেই এই নাম মুখে আনিনি কখনো আর। মেয়েরা তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায় না। আমার স্ত্রীও এর ব্যতিক্রম হয় কী করে? মাঝেমধ্যে অবশ্য সে কুসুম প্রসঙ্গ তুলে এখনো, আমি রহস্যময় হাসি দিই। যার অর্থ এই নামে কেউ আছে, আবার নাইও। আমার স্ত্রীর চোখ জুড়ে যথারীতি থাকে রাজ্যের বিস্ময়।

রহস্য রহস্য খেলা অনেকদিনই তো হলো, মাঝেমাঝে ভাবি, এবার তো অন্তত রহস্যের খোল খুলে দেওয়া যায়। তা ওই ভাবা পর্যন্তই। রহস্য রহস্যই থেকে গেছে তাই আজ অব্ধিও।

অনেক বছর পর আবার নতুন করে পড়তে গিয়ে, এই ক'দিনে উপন্যাসটা পঁয়ষট্টি পৃষ্ঠার মতো পড়েছি। পাতার পর পাতা উল্টাই আর কুসুমের প্রতি আমার সেই তীব্র আবেগ আবার নতুন করে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

যেন এখনো আমি অপেক্ষায় আছি, কখন উপন্যাসের কুসুমের মতো করে কোনো প্রণয়িনী গভীর আহ্লাদে ডেকে উঠবে আমাকেও--'ছোটবাবু...'

সেই ডাক শুনে আমার ভেতরে দীর্ঘকাল ধরে ঘুমিয়ে থাকা শশী ডাক্তার মানুষটা যদিবা জেগে উঠে আবার!   

Comments