নতুন বার্তা
শহিদুল ইসলাম আকাশ
মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশে বসা মা-বাবার দিকে একটু পরপর আড়চোখে তাকাচ্ছে এই মেয়ে। দৃষ্টিতে তার গাঢ় অবিশ্বাস__জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত যাঁরা ছিলেন বড় চেনা__ভিনগহের কোনো জীবের মতো সেই বাবা-মাকেই কেমন যেন বড় অচেনা মনে হচ্ছে তার।
সবে নবম শ্রেণিতে পড়ে মেয়েটি। চেহারায় এখনো কৈশোরের সারল্য স্পষ্ট। এটুকু বয়সেই অসম্ভব রূপবতীই বলা যায় তাকে, ক্রন্দনরত অবস্থাতেও তাকে জ্যোতির্ময়ীর মতো দেখাচ্ছে।
এই অপরূপ রূপই মেয়েটির জীবনে কাল হলো! পাশের গ্রামের প্রায় মধ্যবয়সী বিপত্নীক এক ধনাঢ্য ব্যক্তি এই মেয়েকে পছন্দ করেছেন। তিনি মেয়ের পরিবারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। দুবাইতে ব্যবসা আছে, সামাজিক মর্যাদাও আছে ঢের, চট্টগ্রাম শহরে কয়েকটা বাড়ি আছে__কন্যাদানের জন্য এমন পাত্র হয়তো হাতছাড়া করার পক্ষপাতী নন হতদারিদ্র মেয়েটির বাবা-মা। পাত্রের বয়স একটু বেশি, এটুকু খুঁত ধর্তব্যের মধ্যে পরে না বলেই ধরে নিচ্ছেন তাঁরা।
সব কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত। বিয়ের দেনমোহর, সম্ভাব্য তারিখ, কতোজন বরযাত্রী__সব নির্ধারণ হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটিকেই শুধু কিছুতে রাজি করানো যাচ্ছে না। মেয়েটি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সে পড়ালেখা করবে, লেখাপড়া করে একদিন সে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এখনই সে কিছুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। যদি জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সে আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নেবে।
মেয়েটির বাবা-মা তাই তাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছেন, আমি যেন তাঁদের মেয়েকে বুঝিয়ে এই বিয়েতে রাজি করাই।
আমি তাঁদের বললাম, আপনাদের মেয়ের এখনো বিয়ের যথাযথ বয়স হয়নি। ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া অপরাধ। কারণ, সংসার ও সন্তানধারণে অল্প বয়সী মেয়েরাই বেশি ঝুঁকিতে থাকে। মেয়ে পড়তে চাইছে, ভালো হয়, তাকে পড়ালেখা করতে দিলে। আজকাল মেয়ে-ছেলেতে কোনো বিভেদ কি আছে? মেয়ে নয়, তাকে মানুষ হওয়ার সুযোগ দিন।
মেয়েটির বাবা-মা আমার কথায় বেজায় অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, আমরা এসেছি আপনি মেয়েকে বুঝাবেন এ জন্য, আপনি দেখি আমাদেরকেই বুঝাতে চাইছেন। ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকাটা যে কী যন্ত্রণার তা আপনি বুঝলেন না।
মেয়েটিকে নিয়ে তাঁরা চলে গেলেন।
পরে শুনলাম, সেই মাঝবয়সী, বিপত্নীক পুরুষটির সাথেই মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। বয়স কম হওয়ায় কোর্টে গিয়ে কীভাবে কীভাবে বিয়ের কাজটা সারতে হয়েছে। আত্মহননের কথা বললেও, মেয়েটি শেষ পর্যন্ত তা করেনি। লোকভয়, লজ্জা, পারিবারিক মানসম্মানের কথা ভেবে হয়তো মেয়েটি এই কঠিন সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেছে।
কিন্তু বিয়ের তিন মাসের মাথায় মেয়েটির বাবা-মা আবার আমার কাছে এসে হাজির। জানালেন, তাঁদের মেয়েটি খুব একটা সুখে নেই। স্বামীর সাথে বনিবনা হয় না, মেয়ের গায়ে এরই মধ্যে হাত তুলেছেন কয়েকবার, তাছাড়া মেয়েটি শারীরিকভাবেও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখনই তাঁরা ছাড়িয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন না আবার এহেন অবস্থায় কী করা যায় তাও ভেবে পাচ্ছেন না।
সেদিন তাঁদের আমি সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছুই বলতে পারিনি।
আরো কয়েক মাস পরে মেয়েটি তাঁর বাবার বাড়িতে বেড়াতে এলে আমি তাঁকে দেখতে যাই। তখন সন্তানসম্ভবা সে। চেহারায় তার আগের সে জৌলুশ নেই, অল্প বয়সে সন্তানধারণজনিত শারীরিক অস্বাভাবিকতা প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। মুখে সে কিছুই বলছে না, কিন্তু তার নীরবতা জানিয়ে দিচ্ছিলো, সে সুখে নেই।
এর মাস সাতেক পর জানলাম, মেয়েটি একটি মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছে, সেও গুরুতর অসুস্থ। এই অসুস্থতার মধ্যেও মেয়েটির উপর তার স্বামীর নানারকম মানসিক অত্যাচার অব্যাহতই রইল__আবার বিয়ে করার হুমকি থেকে শুরু করে, মেয়েটিকে তালাক দেওয়ার কথাও বলতে লাগলেন। সংসারে বাবা-মার অসহায়ত্বের কথা ভেবে মেয়েটি এই সবই মুখ বুজে সয়ে যেতে লাগলো।
কিন্তু সব নোঙর ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ঢেউও যে জীবনে কখনো কখনো আসে। দেনমোহর ও যাবতীয় খোরপোশ বুঝিয়ে দিয়ে, শেষ পর্যন্ত স্বামী চূড়ান্ত বিচ্ছেদেই গড়িয়ে দিলো।
খবরটা আমি শুনেছি, বেশ কয়েক মাস পর। শুনে আমি আশ্চর্য হয়নি, অল্প বয়সে মেয়ে বিয়ে দিলে এমন একটি আশংকার কথা বিয়ের আগেই আমি মেয়েটির বাবা-মাকে বলেছিলাম।
আমি মেয়েটিকে একদিন দেখতে গেলাম। আমাকে কে যেন একবার বলেছিলেন, 'তোমার দুই পায়ের মত জীবন যাপন করো , ঠিক যেমন এক পা সামনে এগিয়ে গেলেও অহংকার করে না এবং অপর পা পিছিয়ে থাকলেও লজ্জিত হয় না। কারন তারা উভয়েই জানে তাদের অবস্থান পরিবর্তন হবেই।' সে কথাগুলো মেয়েটিকে বললাম।
বললাম, তুমি আবার পড়ালেখা শুরু করো। সব নোঙর ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ঢেউ জীবনে এলেও, কোনো কোনো নোঙর তো ঠিকই তীর খুঁজে পায়। তুমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলো, তোমার সে অভীষ্ট লক্ষ্যে তুমি এগিয়ে যাও। তারপর একদিন যখন তুমি অনেক বড় ডাক্তার হবে, তখন তুমি সবাইকে বুঝাবে যে, অল্প বয়সে কখনোই কোনো মেয়ের বিয়ে নয়।
আমার কথায় সে আশ্বস্ত হলো। বললো, সে তাই করবে।
আমি যখন ফিরে আসছি, তখন হঠাৎ শব্দ করে সে কেঁদে উঠলো। ফিরে আসতে আসতে আমি মনে মনে বললাম: জন্মের পর শিশু যখন কেঁদে উঠে, তখন সে কান্না এক নতুন শুরুর বার্তা নিয়ে আসে। মেয়েটির এই কান্নাও আরেকটি নতুন শুরুর সম্ভাবনা হোক।
মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশে বসা মা-বাবার দিকে একটু পরপর আড়চোখে তাকাচ্ছে এই মেয়ে। দৃষ্টিতে তার গাঢ় অবিশ্বাস__জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত যাঁরা ছিলেন বড় চেনা__ভিনগহের কোনো জীবের মতো সেই বাবা-মাকেই কেমন যেন বড় অচেনা মনে হচ্ছে তার।
সবে নবম শ্রেণিতে পড়ে মেয়েটি। চেহারায় এখনো কৈশোরের সারল্য স্পষ্ট। এটুকু বয়সেই অসম্ভব রূপবতীই বলা যায় তাকে, ক্রন্দনরত অবস্থাতেও তাকে জ্যোতির্ময়ীর মতো দেখাচ্ছে।
এই অপরূপ রূপই মেয়েটির জীবনে কাল হলো! পাশের গ্রামের প্রায় মধ্যবয়সী বিপত্নীক এক ধনাঢ্য ব্যক্তি এই মেয়েকে পছন্দ করেছেন। তিনি মেয়ের পরিবারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। দুবাইতে ব্যবসা আছে, সামাজিক মর্যাদাও আছে ঢের, চট্টগ্রাম শহরে কয়েকটা বাড়ি আছে__কন্যাদানের জন্য এমন পাত্র হয়তো হাতছাড়া করার পক্ষপাতী নন হতদারিদ্র মেয়েটির বাবা-মা। পাত্রের বয়স একটু বেশি, এটুকু খুঁত ধর্তব্যের মধ্যে পরে না বলেই ধরে নিচ্ছেন তাঁরা।
সব কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত। বিয়ের দেনমোহর, সম্ভাব্য তারিখ, কতোজন বরযাত্রী__সব নির্ধারণ হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটিকেই শুধু কিছুতে রাজি করানো যাচ্ছে না। মেয়েটি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সে পড়ালেখা করবে, লেখাপড়া করে একদিন সে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এখনই সে কিছুতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। যদি জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সে আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নেবে।
মেয়েটির বাবা-মা তাই তাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছেন, আমি যেন তাঁদের মেয়েকে বুঝিয়ে এই বিয়েতে রাজি করাই।
আমি তাঁদের বললাম, আপনাদের মেয়ের এখনো বিয়ের যথাযথ বয়স হয়নি। ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া অপরাধ। কারণ, সংসার ও সন্তানধারণে অল্প বয়সী মেয়েরাই বেশি ঝুঁকিতে থাকে। মেয়ে পড়তে চাইছে, ভালো হয়, তাকে পড়ালেখা করতে দিলে। আজকাল মেয়ে-ছেলেতে কোনো বিভেদ কি আছে? মেয়ে নয়, তাকে মানুষ হওয়ার সুযোগ দিন।
মেয়েটির বাবা-মা আমার কথায় বেজায় অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, আমরা এসেছি আপনি মেয়েকে বুঝাবেন এ জন্য, আপনি দেখি আমাদেরকেই বুঝাতে চাইছেন। ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকাটা যে কী যন্ত্রণার তা আপনি বুঝলেন না।
মেয়েটিকে নিয়ে তাঁরা চলে গেলেন।
পরে শুনলাম, সেই মাঝবয়সী, বিপত্নীক পুরুষটির সাথেই মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। বয়স কম হওয়ায় কোর্টে গিয়ে কীভাবে কীভাবে বিয়ের কাজটা সারতে হয়েছে। আত্মহননের কথা বললেও, মেয়েটি শেষ পর্যন্ত তা করেনি। লোকভয়, লজ্জা, পারিবারিক মানসম্মানের কথা ভেবে হয়তো মেয়েটি এই কঠিন সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেছে।
কিন্তু বিয়ের তিন মাসের মাথায় মেয়েটির বাবা-মা আবার আমার কাছে এসে হাজির। জানালেন, তাঁদের মেয়েটি খুব একটা সুখে নেই। স্বামীর সাথে বনিবনা হয় না, মেয়ের গায়ে এরই মধ্যে হাত তুলেছেন কয়েকবার, তাছাড়া মেয়েটি শারীরিকভাবেও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখনই তাঁরা ছাড়িয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন না আবার এহেন অবস্থায় কী করা যায় তাও ভেবে পাচ্ছেন না।
সেদিন তাঁদের আমি সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছুই বলতে পারিনি।
আরো কয়েক মাস পরে মেয়েটি তাঁর বাবার বাড়িতে বেড়াতে এলে আমি তাঁকে দেখতে যাই। তখন সন্তানসম্ভবা সে। চেহারায় তার আগের সে জৌলুশ নেই, অল্প বয়সে সন্তানধারণজনিত শারীরিক অস্বাভাবিকতা প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। মুখে সে কিছুই বলছে না, কিন্তু তার নীরবতা জানিয়ে দিচ্ছিলো, সে সুখে নেই।
এর মাস সাতেক পর জানলাম, মেয়েটি একটি মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছে, সেও গুরুতর অসুস্থ। এই অসুস্থতার মধ্যেও মেয়েটির উপর তার স্বামীর নানারকম মানসিক অত্যাচার অব্যাহতই রইল__আবার বিয়ে করার হুমকি থেকে শুরু করে, মেয়েটিকে তালাক দেওয়ার কথাও বলতে লাগলেন। সংসারে বাবা-মার অসহায়ত্বের কথা ভেবে মেয়েটি এই সবই মুখ বুজে সয়ে যেতে লাগলো।
কিন্তু সব নোঙর ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ঢেউও যে জীবনে কখনো কখনো আসে। দেনমোহর ও যাবতীয় খোরপোশ বুঝিয়ে দিয়ে, শেষ পর্যন্ত স্বামী চূড়ান্ত বিচ্ছেদেই গড়িয়ে দিলো।
খবরটা আমি শুনেছি, বেশ কয়েক মাস পর। শুনে আমি আশ্চর্য হয়নি, অল্প বয়সে মেয়ে বিয়ে দিলে এমন একটি আশংকার কথা বিয়ের আগেই আমি মেয়েটির বাবা-মাকে বলেছিলাম।
আমি মেয়েটিকে একদিন দেখতে গেলাম। আমাকে কে যেন একবার বলেছিলেন, 'তোমার দুই পায়ের মত জীবন যাপন করো , ঠিক যেমন এক পা সামনে এগিয়ে গেলেও অহংকার করে না এবং অপর পা পিছিয়ে থাকলেও লজ্জিত হয় না। কারন তারা উভয়েই জানে তাদের অবস্থান পরিবর্তন হবেই।' সে কথাগুলো মেয়েটিকে বললাম।
বললাম, তুমি আবার পড়ালেখা শুরু করো। সব নোঙর ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ঢেউ জীবনে এলেও, কোনো কোনো নোঙর তো ঠিকই তীর খুঁজে পায়। তুমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলো, তোমার সে অভীষ্ট লক্ষ্যে তুমি এগিয়ে যাও। তারপর একদিন যখন তুমি অনেক বড় ডাক্তার হবে, তখন তুমি সবাইকে বুঝাবে যে, অল্প বয়সে কখনোই কোনো মেয়ের বিয়ে নয়।
আমার কথায় সে আশ্বস্ত হলো। বললো, সে তাই করবে।
আমি যখন ফিরে আসছি, তখন হঠাৎ শব্দ করে সে কেঁদে উঠলো। ফিরে আসতে আসতে আমি মনে মনে বললাম: জন্মের পর শিশু যখন কেঁদে উঠে, তখন সে কান্না এক নতুন শুরুর বার্তা নিয়ে আসে। মেয়েটির এই কান্নাও আরেকটি নতুন শুরুর সম্ভাবনা হোক।


Comments
Post a Comment