অহংকার

শহিদুল ইসলাম আকাশ 

জীর্ণ পোশাকের এক বৃদ্ধা নারী গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন সন্ধ্যার পর থেকে। তিনি এসেছেন আজমল সাহেবের কাছে। আজমল সাহেব এখনো অফিস থেকে ফিরেননি, তাই আজমল সাহেবের স্ত্রী জেসি ম্যাডামকে খবর দেওয়া হয়েছে। দারোয়ান ইন্টারকমে খবরটা দেয়।

জেসি ম্যাডাম সিসি ক্যামেরায় গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধাকে দেখলেন এক পলক। দেখে দারোয়ানকে বললেন, 'দেখে তো মনে হয় সাহায্যটাহায্য চাইতে এসেছে। পরে আসতে বলো।' দারোয়ান পরে আসতে বললো বৃদ্ধাকে। শুনে বৃদ্ধা বললেন, 'আজমল আহুক তারপরই যামু। আমি অনেকদূর থাইকা আইছি। আজমলের লগে দেখা কইরাই চইলা যামু।' দারোয়ান অবাক হলো, এই বৃদ্ধা স্যার বা সাহেব না বলে আজমল বলছেন কেন, ঘটনা কী!

এক ঘন্টা পর জেসি ম্যাডামকে পুনরায় খবর দেওয়া হলো, এতে দারোয়ানের উপর জেসি ম্যাডাম ক্ষিপ্ত হলেন। আজ জেসি ম্যাডামের বাসায় পার্টি আছে, একটু পরেই অতিথিরা আসবে, এই সময় এ কী উটকো ঝামেলা!

পার্টি উপলক্ষে কলকাতা থেকে বাবুর্চি আনা হয়েছে। মুম্বাই থেকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের যাবতীয় আয়োজনের ব্যবস্থাও। দুবাই থেকে দুই মিশরী কন্যাকে আনা হয়েছে, তারা সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে আলোচনায় আসা 'দিলবার দিলবার' হিন্দি গানটার সুরে বেলি ড্যান্স দেখাবে। মেয়ের জন্মদিন বলে কথা, সোসাইটিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে হবে না!

জেসি ম্যাডামের ব্যস্ততার অন্ত নেই। মেয়ের আঠারতম জন্মদিনটা স্মরণীয় করে রাখা চাই। একে একে অতিথিরা আসতে শুরু করলো একসময়। জেসি ম্যাডাম ঘরময় দৌড়ঝাঁপের উপর আছেন। অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাবার পাশাপাশি সবাই কাজকর্ম ঠিকঠাক করছে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে তাঁকে।

এরমধ্যে আজমল সাহেবও ফিরলেন। তাঁর বিলাসবহুল গাড়িটা গেটে ঢুকার সময় দারোয়ান বললো, 'স্যার এই বুড়িটা অনেকক্ষণ ধরে আপনার অপেক্ষায় বসে আছে।' আজমল সাহেব 'বুড়ি'টার দিকে তাকালেন না, তাকাবার যেন সময় নেই তাঁর। একটা বিশ টাকার নোট দারোয়ানের হাতে দিয়ে বললেন, 'এটা দিয়ে বিদায় হতে হলো তাকে।'

দারোয়ান বৃদ্ধার হাতে টাকাটা দিলো। বললো, 'এখন যান।' বৃদ্ধা অবাক চোখে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বৃদ্ধা কি কাঁদছেন!

বৃদ্ধা নড়লেন না। আজমল সাহেবের দেওয়া বিশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে, নোটটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বসে রইলেন ঠায়।

ভেতরবাড়ি থেকে গানের সাথে হইহুল্লোড় ভেসে আসছে। রাত এখন কতো হবে, কে জানে! বৃদ্ধার দু'টি চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে। একটা সময় তিনি গেটের বাইরে ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখে দারোয়ানের ভীষণ মায়া হলো। দারোয়ান পুনরায় ইন্টারকমে খবর পাঠালো। রাগে ক্ষোভে ছুটে এলেন জেসি ম্যাডাম, বললেন, 'এই বুড়ি কী চাস তুই?' বৃদ্ধার ঘুম ভেঙে গেলো। বললেন, 'আমি আজমলের লগে দেখা কইরাই চইলা যামু। অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করছি হের।'

উত্তেজিত জেসি ম্যাডাম বললেন, 'আজমল কী রে, সাহেব বল।' বৃদ্ধা হাসলেন, বললেন, 'তুমি কি আজমলের বউ? বড়ই সৌন্দর্য তো!'

এমন কথাতেও জেসি ম্যাডামের কোনো ভাবান্তর হয় না, তিনি বৃদ্ধাকে তুই তুকারি করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে যেতে লাগলেন তবু।

বৃদ্ধা তাঁর আঁচল সরিয়ে দলাপাকানো কিছু কাগজ জেসি ম্যাডামের হাতে দিয়ে বললেন, 'এটা আজমলকে দিবা। গত মাসে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়। মরণের আগে গ্রামে উনার যতো বিষয়সম্পত্তি আছিলো, সব আজমলের নামে লিইখাপড়ে দিইয়া গেছে। এইগুলান তার দলিল। সম্পত্তিও কম না, সব মিলাইয়া দশ বিঘার উপরে হইবো। বেচলে তোমার এই বাড়ির লাহান আরেকটা বাড়ি বানাইতে পারবা।'

বিশ বছর আগে আজমল সাহেব ঢাকা শহরে লেখাপড়া করতে আসেন। চরম অকৃতজ্ঞের মতো তিনি এরপর আর তার গত জীবনের কথা একবারও ভাবেননি। দেড় বছর বয়সে আজমলের মার মৃত্যু হলে, আজমলের বাবা আবার বিয়ে করেন। এই বৃদ্ধা ও তাঁর স্বামী, তাঁর নিঃসন্তান ছিলেন, তাই আজমলকে নিজের ছেলের মতো করে বড় করতে থাকেন। অপার স্নেহ ও প্রগাঢ় মমতায়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আজমলকে লেখাপড়ার জন্য ঢাকাতেও পাঠান তাঁরা। সেই সময় এক বিঘা  জমি বেচে সব টাকা আজমলের হাতে দেন। কিন্তু আজমল একবারের জন্যও আর তাঁদের খবর রাখেননি।

জেসি ম্যাডাম কাগজটা খুলে দেখতে লাগলেন। দেখলেন, সত্যিই দশ বিঘা জমি তাঁর স্বামী আজমল সাহেবের নামে রেজিস্ট্রি করা। বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন তিনি। এরমধ্যে কখন যে বৃদ্ধা চলে গেলেন, জেসি ম্যাডাম খেয়ালই করেননি তা।

জমির দলিলটা হাতে নিয়ে জেসি ম্যাডাম গেটে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। পুনরায় গেটের বাইরে তাকালেন, যদি বৃদ্ধাকে দেখা যায়!

জেসি ম্যাডাম সড়কবাতির আলোয় এদিকেওদিকে চোখ ঘুরাতে লাগলেন। বৃদ্ধা কোথাও নেই। তাঁর ভেতরটা হাহাকারে পূর্ণ হলো হঠাৎ। অর্থবিত্তের অহংকারের চেয়েও, ভালোবাসার অহংকারটাই যে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ও দামি--এই প্রথম যেন বুঝলেন তিনি।

Comments