ভালোবাসার গল্প

শহিদুল ইসলাম আকাশ

তৌফিক আমার শৈশবের বন্ধু নয়। কলেজে একই সাথে পড়তাম। সেই সময়ে, অল্প কিছুদিনের মধ্যে, সে আমার একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠলো।

আমি তখন একজনের প্রেমে পাগলপারা। রাত জেগে সেই মেয়েটিকে নিয়ে কবিতা লিখি, কল্পনায় রাঙিয়ে নানারকম গল্প লিখি। লিখে তাকে পড়ে শুনাই। সে অভিভূত হয়। দুয়েকটা কবিতা ও গল্প পত্রিকাতেও পাঠাই, ছাপাও হয়। আমার আনন্দ দেখে কে!

অন্যদিকে তৌফিকও একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে সারাক্ষণই অস্থির হয়ে আছে। তৌফিক আমার মতো কবিতা বা গল্প লেখে না। আড়াল থেকে মেয়েটিকে দেখে সে প্রতিদিন, সামনে যায় না। রাতের পর রাত জেগে মেয়েটির ছবি আঁকে আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সে শুধু একটি নামই লিখে যায়--'বীথি', 'বীথি', 'বীথি'...। এক বছরে কয়েক শ'র মতো মেয়েটির ছবি এঁকেছে এবং দশ লক্ষবারের মতো 'বীথি' নামটি লিখে ফেলেছে সে। তৌফিকের টার্গেট কয়েক হাজার ছবি আঁকবে এবং এক কোটিবার সে এই নামটি লিখবে। আমি তার এই পাগলামি দেখে তাকে ক্ষেপাতাম, 'শালা, আর কাজ খুঁজে পেলি না!' 'বীথি' হলো মেয়েটির নাম। তৌফিকের এই পাগলামীর কথা যে বীথি কিছুই জানে না।

তৌফিককে প্রায়ই বলতাম, 'তুই বীথিকে চাস, কিন্তু মুখ ফুটে জানতে দিস না, এটা কেমন কথা?' জবাবে তৌফিক বলতো, 'সে যদি ফিরিয়ে দেয়!'

'তোর মতো ভীরুর প্রেমে পড়াই উচিত না', এটা বলে তাকে লজ্জা দিতে চাইতাম, চাইতাম সে আরেকটু সাহসী হোক। বীথিকে স্পষ্ঠ জানিয়ে দিক যে, সে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। রাত জেগে তৌফিক ছবি আঁকে আর বীথি নামটা লিখে যেতেই থাকে। সকালে কলেজে এসে বলতে থাকে, এই পর্যন্ত বীথির কয়টা ছবি সে এঁকেছে আর কতো লক্ষ কতো হাজার কতো শ কতো 'বীথি' নামটা লেখা হলো।

তৌফিককে না-জানিয়ে একদিন আমিই বীথির মুখোমুখি হলাম, বললাম, 'বীথি, তুমি কি জানো, এই পৃথিবীতে তুমি কী ভাগ্যবতী একটা মেয়ে?' আমার কথায় বীথি অবাক হলো। বললো, 'হঠাৎ এমন কথা কেন?' বললাম, 'একটা ছেলে রাতের পর রাত জেগে শয়ে শয়ে তোমার ছবি আঁকে, লক্ষ লক্ষবার তোমার নামটি লিখে তোমার প্রতি বিরামহীন ভালোবাসা প্রকাশ করে যায়--তুমি ভাগ্যবতী নয় তো কে, বলো?'

বীথি চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, বললো, 'আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! কার কথা বলছেন আপনি?' আমি তৌফিকের নাম বললাম। বীথি একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

এর একদিন পরে কলেজ ছুটির পর আমি আর তৌফিক বের হচ্ছি। পিছন থেকে তৌফিকের নাম ধরে বীথি ডেকে উঠলো। আমি যতোটা না অবাক, তারচেয়ে বেশি অবাক হলো তৌফিকই। বীথি সামনে এগিয়ে এসে, তৌফিকের দিকে তাকিয়ে বললো, 'আপনি নাকি রাত জেগে একের পর এক কোন একটি মেয়ের ছবি আঁকেন আর সাদা কাগজে লক্ষ লক্ষবার সেই মেয়েটির নাম লিখেছেন ইতিমধ্যেই? কথা কি সত্য? গিনেসরেকর্ডে নিজের নাম উঠাতে চান নাকি?' বলেই হাসলো বীথি। হাসলো তৌফিকও।

পুনশ্চ:
বীথি তৌফিককে ফিরিয়ে দেয়নি। তৌফিককে ভালোবেসেছে সে কিছু বাকি রা-রেখেই। তৌফিকেরই মতো।

এই লেখা ধৈর্যসহকারে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের মধ্যে আগ্রহী কারো হয়তো কৌতূহল থাকতে পারে, তৌফিক ও বীথির প্রেম শেষতক বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে কিনা।

এই কৌতূহল আমি মিটাতে চাই না। ভালোবাসা তো ভালোবাসাই, শুধুমাত্র তিন কবুলে তার শূন্যতা বা পূর্ণতা নির্ভর করে কি?

Comments