যুদ্ধদিনের গল্প

শহিদুল ইসলাম আকাশ


রাত দুপুরে সাতজনের একটি দল ঘরের উঠোনে। দরোজাটা খুলতে গেলে শব্দ হয়, ঝুমুরের মা দরোজা যেই খুললেন, দরোজার শব্দে ষোড়শী ঝুমুরের ঘুম ভেঙে গেলো। এই বাড়িতে ঝুমুর আর তার মা-ই শুধু। ঝুমুরের বাবাও ছিলেন, ছয় মাস আগে কিছু পাকিস্তানি মিলিটারি তাঁকে স্থানীয় হাটে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। ঝুমুরের বাবার অপরাধ, তাঁকে আল বদর কমিটিতে থাকতে বলা হয়েছিলো, তিনি থাকতে রাজি হননি।

এ কি, মা দেখি নিচু স্বরে অপরিচিত সাত তরুণের সাথে কথা বলছেন! দরোজায় দাঁড়িয়ে হারিকেনের আলোয় সাতজনকেই স্পষ্ট দেখতে পেলো ঝুমুর। বয়সে তরুণ সবাই। একজন তো দেখতে রাজপুত্রের মতো। ঝুমুর ভাবে, এরা কারা! মা নিশ্চয় তাদের আসার কথা আগে থেকেই জানতেন! দেশে যুদ্ধ চলছে, মার এক দূর-সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে নাকি মুক্তিযোদ্ধা, সঙ্গী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তার এই বাড়িতে আসার কথা মা বলেছিলেন কয়েকদিন আগে। এরাই কি সেই মুক্তিযোদ্ধা!

দুইটা মাত্র রুম ঝুমুরদের ঘরে। একটাতে তাদের থাকতে দেওয়া হলো। ছোট্ট ঘর, তাতে গাদাগাদি করে থাকতে হবে তাদের সাতজনকে। রাত দুপুরে ঝুমুরের মা এই অতিথিদের জন্য রান্নাবান্না করতে রান্নাঘরে ডুকলেন। ঝুমুরও গেলো সাথে। রান্না করতে করতে ঝুমুরকে তার মা বললেন, 'হ্যাঁ, এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।'

খাওয়াদাওয়া সেরে ঘন্টাখানেক মতো বিশ্রাম নিয়ে ভোরের আলো ফুটার আগেই বেরিয়ে গেলো তারা।  যাবার আগে বলে গেলো, রাতে আবার আসবে তারা। এই গ্রামে কিছুদিন থাকতে হবে তাদের, এই ক'দিন রাতেরবেলা এখানে এসে থাকবে তারা।

এরপর থেকে, প্রতি রাতেই যে তারা আসতো তা না, তবে প্রায়ই আসতো। ঝুমুর সেইসব রাতে তাদের কাছে প্রতিদিনের যুদ্ধের গল্প শুনতো। তারাও খুব আগ্রহ নিয়ে বলে যেতো। শুনতে শুনতে ঝুমুর আড়চোখে রাজপুত্রের মতো রূপবান ছেলেটার দিকে তাকাতো, মানুষ এতো সুন্দর হয়!

ততোদিনে সবার নামের সাথে সেই ছেলেটার নামও জানা হয়ে গেছে ঝুমুরের। ছেলেটার নাম আলম, ভালো নাম নুরুল আলম। বড়লোকের ছেলে, এমএ পাশ। দেশের প্রতি ভালোবাসার টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে সে।

দেখতে দেখতে আলমের প্রতি এক ধরনের আচ্ছন্নতা টের পায় ঝুমুর। কথা খুব কম বলে আলম, রাতে সবাই যখন সারাদিনের যুদ্ধের বর্ণনা করে ঝুমুরের সাথে, তখন হাতে বই নিয়ে বইয়ের ভেতর ডুবে থাকে সে। ব্যাগভর্তি বই ছিলো তার।

এক রাতের কথা। তারা পাঁচজন এসেছে সেদিন, বাকি দুই জন আসেনি। কোথায় তারা! আলমের কাছেই প্রশ্নটা করলো ঝুমুর। আলম নিরুত্তর। যথারীতি একটা বই খুলে তাতে মগ্ন হয়ে গেলো। একজন বললো, 'ওরা দু'জন আজ হলদিয়ায় শহীদ হয়েছে। মুখোমুখি যুদ্ধ ছিলো। গুলি সরাসরি বুকে এসে লাগে তাদের, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।'

তাই শুনে ঝুমুর বিষণ্ণ হয়ে যায়। আলমের দিকে চোখ রাখে সে, আলম বই পড়ছেই। কিছুই বলছে না, কোনো ভাবান্তরও নেই তার। যেন যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যু এমন কোনো বড় ঘটনা নয়। আলমেরও এমন মৃত্যু হতে পারে এবং এইজন্য তার কোনো দুশ্চিন্তাও যেন নেই। যেন দেশটা স্বাধীন করাই আসল কাজ।

আচ্ছা, যুদ্ধ করার সময় এমন করে আলমের বুকেও যদি গুলি লাগে কখনো! মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত দেহটা যদি ছটফট করতে থাকে, আলমকেও যদি শহীদ হতে হয়! না, আর ভাবতে পারে না ঝুমুর। মাথাটা ঝিমঝিম করে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠে তার। এখনই কেঁদে ফেলবে যেন। আলমের জন্য কেন এমন মায়া অনুভূত হচ্ছে ঝুমুরের, তবে কি ঝুমুরের অজান্তেই আলম জয় করে নিয়েছে ঝুমুরের হৃদয়ের নন্দনবন! বুঝে না ঝুমুর।

এরমধ্যে এই অঞ্চল পাকিস্তান হানাদারমুক্ত করে আলমরা। পরবর্তী যুদ্ধের জন্য অনেক দূরের কোনো একটা গ্রামে যেতে হবে তাদের। যাবার আগের রাতে আলমের পাশেপাশে ঘুরছিলো ঝুমুর। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! যুদ্ধে যদি আলমের কিছু একটা হয়ে যায়, আলমের অন্য দুই সহযোদ্ধার মতো যদি শহীদ হতে হয় আলমকেও! তাহলে তো আর দেখা হবে না কোনোদিনই!

ঝুমুরের এই উৎকণ্ঠা আলম বুঝতে পারে, কিন্তু প্রকাশ করেনি কখনো। যাবার আগের রাতে ঝুমুরকে একান্তে ডেকে নিলো আলম, বললো, 'ঝুমুর, আমি জানি তুমি মনে মনে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছো, মানে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছো। সত্যি বলতে কী, আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি দেশটাকে স্বাধীন করা ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না। সকালে চলে যাবো, দূরের এক গ্রামে যেতে হবে। কথা দিচ্ছি, এই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি তোমার কাছে ছুটে আসবো।'

কেঁদে উঠলো ঝুমুর, বললো, 'আর যদি দেশ স্বাধীন না-হয়! আর যদি যুদ্ধে তোমার কিছু একটা হয়ে যায়!'

হাত বাড়িয়ে ঝুমুরের চোখের জল মুছে দিতে দিতে আলম বললো, 'এই দেশ অবশ্যই স্বাধীন হবে তুমি দেখো। প্রার্থনা করো, আমি যেন জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারি। তুমি শুধু অপেক্ষায় থেকো।'

পরদিন সকালে আলমরা চলে গেলো। যাওয়ার সময় বারবার ফিরে ফিরে ঝুমুরকে দেখছিলো আলম। ঝুমুর জানে না, সত্যিই এই দেশ স্বাধীন হবে কিনা, ফিরে আসা হয় কিনা আলমের। ঝুমুর প্রার্থনা করে, এই দেশ যেন অবশ্যই স্বাধীন হয়, স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে যেন আসে আলম।

দিন যায়। রাত আসে। আলমের জন্য ঝুমুরের ভেতরটা হাহাকার করতে থাকে প্রতিনিয়ত। কোনো কোনো একান্ত মুহূর্তে চোখ বুজে ঝুমুর মনে মনে কল্পনা করে, এই যেন ফিরে এলো আলম। আলমের হাতে লালসবুজের পতাকা। অভিভূত আলম সেই পতাকা ঝুমুরের হাতে দিয়ে বলছে, 'এই দেশটাকে আমি যতোটা ভালোবাসি, ঠিক ততোটাই ভালোবাসা তোমার জন্য ঝুমুর।' এইসব ভাবতে ভাবতে ঝুমুরের দু'টি চোখে উথলে উঠে জল। হাতের উল্টো পিঠে সেই জল মুছে নেয় ঝুমুর।

ঝুমুর অপেক্ষায় থাকে। সব অপেক্ষাই শেষ হয় একদিন। সেই দিনটার জন্য সে কী ব্যকুলতা ঝুমুরের বুকের মধ্যে!

Comments