চিঠি
শহিদুল ইসলাম আকাশ
মিতু, ভালো আছো জানি। শুভকামনাও এই, ভালো থাকো নিরন্তর, সুখেই থাকো।
শেষবার সেই কবে তোমার সাথে দেখা! সে কতোদিন, ক-তো-দি-ন, ক-ত্ব-দি-ন! বুকের আকাশে মেঘ রেখেও ঠোঁটের কোণায় রোদ্দুর ফুটিয়ে কথা বলেছি তখন অঝর। আমি যখন বললাম, 'তুমি আগের চেয়েও আরো বেশি রূপবতী হয়েছো; ডানাকাটা পরীর মতো লাগছে যেন, যেন এইমাত্রই ডানা কাটা হয়েছে,' তখন তুমি বলেছো, আমি নাকি একটুও বদলায়নি। জবাবে আমি বলেছিলাম, 'কেন? কথা কি ছিলো বদলাবার?'
আমার বুকের মেঘ উথলে উঠছিলো চোখে, তবু কী এক আশ্চর্য ক্ষমতাবলে সে জল আমি সামলেছি; নিদারুণ, নিপুন।
সামলেছি, কিন্তু যদিবা উথলে উঠতোই চোখে বুকের এই অনন্ত মেঘমালা, তুমি কি তখন বুঝতে পারতে এই করুণ সত্য যে--আজো ভালোবাসি?
সেই যে দেখা, তারপরে তো কেটে গেছে আরো অনেক অনেক দিন, হাজার রাতের গায়েও জমেছে শিশির--আজো তবু আমি এই অমলিন ভালোবাসা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি। তুমি কি কখনো জানবে না তা? কোনোদিনও কি না?
সেই তুমি, আমার পিছু ধেয়ে চলা সেই তোমার স্মৃতির ফেউ--এই নিয়ে কাটে আমার দিবসরজনী। ভালোবাসার যেমন কোনো ব্যাখ্যা থাকে না, ব্যাখা থাকে না ভালো না-বাসারও-- এই মনে রাখার পেছনেও হয়তো কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। ব্যাখ্যা আমি খুঁজেছিও কি কখনো? কোনোদিন? বিনিময় আশা করে যে ভালোবাসা, সেই ভালোবাসায় তো আমার বিশ্বাস ছিলোই না কোনো কালে।
এক সাথে হেসেখেলে বড় হয়েছি আমরা। শৈশবের সেই সব কথা কি মনে আছে তোমার--যখন হাওয়ার ডানায় ভেসে বেড়াতাম আমরা? ছিলো না কোনো পিছুটান যখন, মনে আছে?
যখন যৌবনে এসে পা রাখলাম, আমরা কেউ কাউকেই বলিনি ভালোবাসি; ভালোবাসাই পরস্পরকে বলেছে নৈঃশব্দ্যে--আমরা ভালোবাসি।
সেই সময়ে এখনকার মতো যোগাযোগের এমন অবাধ প্রযুক্তি ছিলো না--না ছিলো ফোন, এসএমস; ফেসবুক, হোয়াটস আপ, ইমুর মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইচ্ছে হলেই হতো না মনের ভাব প্রকাশ কিংবা হতো না ইচ্ছে হলেই বহুদূরে থেকেও একজন আরেকজনকে দেখার সুযোগ। তবু সে সময়ের একটু চোখাচোখি, কখনোবা চিঠি দিতে গিয়ে হাতের খানিক স্পর্শ--এর আবেদনও একটুও কম ছিলো না তখন। অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগের প্রেমিকপ্রেমিকারা তা কি কখনো বুঝবে?
সেই খানিক চোখের দেখা, হাতের ঈষৎ স্পর্শ--এটুকু স্মৃতিই আজো হাজারটা শীতরাত্রি উষ্ণ করে তুলে, হাজার তাপদাহের রাতে বাড়িয়ে দেয় শীতল ছোঁয়া।
মেয়েরা যতোটা না ভালোবাসার কাঙাল, তারচেয়ে বেশি নির্ভরতার কাঙাল। আদিকাল থেকেই মেয়েকে পাত্রস্থ করতে শিক্ষার চেয়ে, সৌন্দর্যের চেয়ে অর্থনৈতিক দিকটাই বেশি প্রাধান্য দেওয়ার যে রীতি অভিভাবকদের, সে রীতি আজও অব্যাহতই আছে। মেয়েদের রক্তেও এই মিথ ঢুকে গেছে যে, স্বামীর অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত থাকাই ভবিষ্যতের আদর্শ। তুমিও এর ব্যতিক্রম ছিলে না। ব্যতিক্রম ছিলে না বলেই, আমার মতো এই বাউণ্ডুলে, বেকারকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্বান্তও নিয়েই নিলে একটা সময়।
আমার বলার মতো তেমন কিছুই ছিলো না তখন। না ব্যবসা, না চাকরিবাকরি। এমন কাউকে হয়তো ভালোবাসা যায়, কিন্তু বিয়ে? বিয়ে হয়তো কখনোই নয়। গায়ের জোরে, টাকার জোরে নয়--আমি তোমাকে পেতে চেয়েছিলাম ভালোবাসার জোরে, বিশ্বাসের দরেই। অথচ দেখো, এই ভালোবাসার ক্ষমতা কখনো কখনো এতোটাই নগণ্য হয়! বিশ্বাস হয়ে উঠে মূল্যহীন।
তোমার বিয়ের আগে একদিন তুমি আমার সামনে এসে হাজির। বললে, তুমি দাওয়াত করতে আসোনি, তুমি এসেছো আমাকে প্রতিজ্ঞা করাতে। আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, তোমার বিয়েতে আমি যেন না যাই। কিছুতেই যাবো না কথা দিতে হবে।
এমন ছেলেমানুষির প্রয়োজন ছিলো না। প্রতিজ্ঞা বা কথা দেওয়ার ব্যাপারটাও হাস্যকর ছিলো। তবু বলেছি, 'কেন? গেলে কি তুমি বিয়ের আসর ছেড়ে আমার সাথে চলে আসবে?'
আমি কথা রেখেছি। বিয়েতে যাইনি। তোমার বিয়ের দিন আমি কোথায় ছিলাম, আমি নিজেও জানি না। নাটাই থেকে সুতো ছিঁড়ে গেলে, ঘুড়ি কি আর জানে কোথায় কোথায় সে ঘুরে? শুধু জানি, নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়েছিলো সেদিন খুব। আত্মহত্যার কথাও কি ভাবিনি তখন!
বিয়ের আগে শেষবার যখন তোমার সাথে দেখা হয়েছিলো, তুমি বলেছিলে, 'তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি, কিন্তু তোমার শূন্যতা পূরণ করতে অন্য একজন আমার জীবনে ছায়া ফেলার অপেক্ষায় আছে ছাতিমের মতো। তারপর একদিন হয়তো এমনি করে তোমার জীবনেও অন্য কেউ আমার শূন্যতা মিটিয়ে দেবে। প্রকৃতির এই এক নিয়ম, শূন্যস্থান রাখে না, পূরণ করে দেয়ই।'
তুমি কি ঠিক বলেছিলে? সত্যিই কি প্রকৃতি শূন্যস্থান পূরণ করে দেয় বা দিতে পারে? হয়তো পারে, কিন্তু সব শূন্যস্থানই কি পারে? মনের শূন্যস্থান পূরণ করার ক্ষমতা কি প্রকৃতির আছে?
খরতাপে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে, শীতার্ত দিনে থরোথরো কেঁপে একপলক তোমাকে দেখার জন্য যে দাঁড়িয়ে থাকতাম দিনের পর দিন, চোখে চোখ রেখে পলক ফেলার যে প্রতিযোগিতায় মেতে থাকতাম, হাতের একটু স্পর্শে যে শিহরণ বয়ে যেতো সদরেঅন্দরে--কোনো বিষণ্ণ বিকেলে যখন তোমার জানালায় সন্ধ্যা নামে, তখন কি এইসব টুকরাটাকরা স্মৃতি একটুও মনে না তোমার? যদি পড়েই, তখন কি তুমি এই কথা স্বীকার করে নিয়ে মনে মনে বলে উঠো: 'কী ভুল ছিলাম আমি! প্রকৃতি শূন্যস্থান রাখে না ঠিকই, কিন্তু সব শূন্যস্থান কখনোই নয়--মনের শূন্যস্থান পূরণ করার ক্ষমতা আসলেই প্রকৃতির নেই।'
সপ্তাহখানেক আগে আমার বন্ধু ফজলু আর আমি পাড়ার মোড়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। চা খেতে খেতে ফজলু জানালো, তোমার সাথে নাকি কিছুদিন আগে ফজলুর দেখা হয়েছে। ব্যবসার কাজে ফজলু তোমাদের শহরে গেলে সেখানে কোন এক মার্কেটে নাকি ফজলু তোমাকে দেখে ডাক দেয়। ফজলুকে চিনতে নাকি তোমারও একটুও কষ্ট হয়নি। বেশ কিছু কথাটথা বলার পর ফজলু যখন আমার প্রসঙ্গ তুললো, তখন তুমি নাকি বলেছো, 'কতোদিন আগের কথা। ওসব ছেলেমানুষি দিনগুলো আজ আর মনে করার কোনো মানে হয়?' তারপরই 'বাসায় ছেলেটা একা, অফিস থেকে তাঁরও ফেরার সময় হয়ে এলো, এখন যাই ফজলু ভাই', বলেই তুমি নাকি চলে যেতে পাশ ফিরেছো। একটু এগিয়ে আবার থেমে নাকি এও বলেছিলে, 'বাসায় আসবেন। এখানে আমাদের তেমন কোনো স্বজন নেই বললেই চলে। বাড়ি থেকে কখনো কেউ এলে আমার স্বামীও ভীষণ খুশি হয়।' এরপর তুমি তোমার হাতব্যাগ থেকে তোমার স্বামীর একটা কার্ড ফজলুর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছো।
মাঝে মাঝে ভাবি, এমনি করে কখনো আবার যদি দেখা হয়ে যায় তোমার আমার, এমনি করেই যদি তুমি বলে বসো, 'বাসায় ছেলেটা একা, অফিস থেকে তাঁরও ফেরার সময় হয়ে এলো, এখন যাই...', বলেই তুমি যদি চলে যেতে পা বাড়াও, তখন আমার কেমন অবস্থা হবে! আমি কোথায় যাবো তখন! আমার জন্য তো কোথাও কেউ অপেক্ষা করে নেই, ছিলোও কি কখনো?
ফজলুর কথা শুনে আমারও কেন জানি না, তোমার শহরে গিয়ে তোমাকে একবার দেখে আসার ইচ্ছে হলো। ফজলুকে সেদিন তুমি তোমার বাসার ঠিকানাও দিয়েছিলে। ফজলুকে নিয়ে যেতে পারি। ফজলুকে বলার পর, সেও রাজি হলো।
গেলাম।
বারো ঘন্টার দীর্ঘযাত্রা শেষে তোমার বাসার সামনে গিয়ে থমকে গেলাম। আমার ভেতরে দ্বন্দ্ব, তোমার বাসায় ঢুকবো? দেখা হলে কী বলবো? হয়ও যদি, তাহলে তুমি এখন আর আমার নও, এই নির্মম সত্য ভুলে আমি যদি ছুঁয়ে ফেলি তোমার হাত, শিল্পের গোপন অনুসঙ্গ--আমার খুব ভয় হতে লাগলো--কী হবে তখন! কী হবে তখন!
ফজলুকে বললাম, 'দোস্ত, চল ফিরে যাই। বাসাটা তো চিনে গেলাম। অন্য কোনো একদিন এসে দেখা করে যাবো।'
আমার কথায় ফজলু অবাক, বললো, 'বারো ঘন্টার দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি শরীরে, দেখা করার জন্য এসে দেখা না করেই চলে যাবি?'
বললাম, 'হ্যাঁ চলে যাবো। কোনো যুক্তিটুক্তি দেখানোর প্রয়োজন নেই, চল ফিরে যাই।'
এই এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে তোমার বাসার সামনে গিয়েও, দেখা না করেই চলে আসলাম। মনে মনে সান্ত্বনা দিলাম, যে বাতাসে তুমি নিঃশ্বাস নাও এখন, সেই একই বাতাসে আমারও কিছু শ্বাস নেওয়া তো অন্তত হলো। এও কি কম পাওয়া?
ফেরার সময় ট্রেনের জানালা দিয়ে দূরে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ একটা বোবাকান্না আমার ভেতরে আর্তনাদ করতে লাগলো। দেখা করতে এসেও কেন দেখা করলাম না? অভিমানে? আমার অভিমান আমার ভালোবাসার মতোই যে এতো তীব্র--আগে জানা ছিলো না তো!
মিতু, রাত জেগে জেগে এতো কথার এই যে চিঠি লিখছি, লিখতে লিখতে আমার ভেতর থেকে কে যেন একজন হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো: এই চিঠি কি কখনো তোমার হাতে পৌঁছবে? নাই যদি পৌঁছুবে তো কেন এই চিঠি লেখা?
এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা, তবু আমি নিরুত্তর থাকি। এমন সময় কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। হয়তোবা উত্তর জানা, এই কথাটাও সঠিক নয়--হয়তোবা এর উত্তর আমারও অজানা।
ভালো আছো, ভালোই থাকো। কখনোকখনো এমন শিশিরের টুপটাপ কান্নার শব্দে জেগে থাকা রাতে আবার হয়তো এমন কোনো দীর্ঘ চিঠি লিখতে বসবো তোমার উদ্দেশে--তুমি কখনো পড়বে না, এই সত্য জেনেও।
এই তো জীবন আমাদের সবার, কয়েক পলকের জীবন--পাথরের মতোই ভারী, একই সাথে আবার পালকের মতোই হালকা। তার মধ্যে কে আমাকে ভালোবাসলো, কে বাসলো না, তার কোনো অর্থ আছে? আমি কাকে এবং কতোটা ভালোবাসি, সেটাই তো বড় কথা হওয়া উচিত। সমস্ত দিনের শেষে রাতে যখন আমি ঘুমাতে যাই, তখন আমার শয্যাসঙ্গী একমাত্র আমিই। তখন নিজের মুখোমুখি শুতে পারাটাই তো আসল পারা।
সেই পারাটাই আজকাল বেশ পারি আমি। কী ভীষণ স্বার্থপরের মতো খুব খুব পারি। পারি বলেই, তোমার প্রতি ভালোবাসা আজও অটুট আছে এবং থাকবেও জানি--চিরদিন; চিরদিন।
Comments
Post a Comment