কঞ্জুষ
শহিদুল ইসলাম আকাশ
কঞ্জুস। এই শব্দটি খোলাসা করে বলার কিছু আছে বলে মনে করি না। এই আখ্যা সেই সব 'মহাত্মা'কেই দেওয়া হয়, যারা অতিশয় কৃপন। চট্টগ্রামবাসীর কাছে শব্দটির উচ্চারণ, 'কমচোস'। কেউ কেউ আবার এর সাথে আরো একটি শব্দ জুড়ে দেন, 'কমচোস মাড়োয়াড়ি'। মাড়োয়াড়ি সম্প্রদায় আসলেই কঞ্জুস কিনা আমার জানা নেই।
আমার জনৈক বন্ধুকে এই অভিধায় অভিষিক্ত করা যায়। তার মতো এমন কঞ্জুস আমি আমার জন্মে দেখিনি। পারে তো সামান্য পিপড়ারও দুধ ধোয়ায় ছাড়ে সে। হাটবারে বাজারে গেলে দেখি, সামান্য এক টাকা দু'টাকা সস্তাদরের আশায় এই দোকান ওই দোকান ঘুরে ঘুরে ফিরে। পাঁচ-দশ টাকা কম ভাড়ার জন্য, চালকের সাথে ঝগড়া বাধায় প্রায়ই।
জমজমাট ব্যবসা, গ্রামে পৈতৃক জায়গাজমি তো আছেই, শহরেও সুরম্য অট্টালিকা। প্রতি মাসে তার ভাড়াও আসে বলার মতো। বাহুল্য হলেও বলা যায় যে, তার সম্পদের পরিধিও বাড়ছে ক্রমশ। তবু তার এমন কঞ্জুসীপনার কী অর্থ, বুঝি না!
বলা হয় দানে সম্পদ বাড়ে বৈ কমে না। এই বাক্যও সে মানতে নারাজ। দান করলে সম্পদ বাড়ে, এমন ভাবনা মূর্খদেরই বলে জানায় সে। গেলোবার ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কিছু মানুষ তার কাছে সাহায্যের আশায় গেলে, তাদের সামনে সে যুক্তি তুলে ধরে, বলে, 'যে কোনো মহামারি আল্লাহপ্রদত্ত। আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষতিতে কোনো ধরণের সাহায্য বা সহযোগিতার অর্থ আল্লাহর বিচারকে অস্বীকার করারই শামিল।'
ক'মাস আগে আমার সে বন্ধু গুরুতর অসুস্থ হয়ে একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন সেখানে তাকে দেখতে গেলাম। সে কথাও বলতে পারছিলো না। তার অসুস্থতা ভয়াবহরকম কিছু, বুঝতে পারলাম। তার পাশে বসা তার স্ত্রীর সাথে কথা বললাম। স্ত্রী বেচারি জানালেন, ডাক্তার বলেছেন তাকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়া উচিত। কিডনিজনিত সমস্যা। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া অতীব জরুরি। কিন্তু সে সাফ জানিয়ে দেয়, ঢাকায় চিকিৎসা করতে গেলে অনেকগুলো টাকা অপচয় করতে হবে, সেই অপচয়ে যেতে সে রাজি নয় কিছুতেই।
বন্ধুকে আমি ঠাট্টা করে বললাম, 'ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখে কী লাভ, যদি না সে টাকা নিজের কাজে আসে? টাকা কি কবরে নিয়ে যাবি নাকি?' যেহেতু সে ভীষণরকম অসুস্থ, তাই আমার এই কথার জবাব তার থেকে আশা করিনি। সেও জবাব দেয়নি বা দিতে পারেনি।
সেই যাত্রায় সে অবশ্য সুস্থ হয়ে উঠে। যে চিকিৎসা দুই লাখ টাকায়ও কুলে উঠতে পারার কথা না, সেই চিকিৎসা সে নাকি পঞ্চাশ হাজারেরও কম খরচে সেরে ফেলতে পেরেছে! অবাক হবার মতোই ব্যাপার।
এই সেদিনের কথা। এক সকালবেলা সে আমার কাছে এলো। হাতে একগাদা দলিলদস্তাবেজ। বললো, নতুন কিছু জমি কিনতে যাচ্ছে সে, সস্তায় পাচ্ছে বলে, এই জমিটা হাতছাড়া করতে চাইছে না কিছুতেই। এই বিষয়ে আমার সাথে আলাপ করতে এসেছে। এমনিতেই তার পৈতৃক সম্পত্তি অঢেল, তারউপর আরো জমি কেনার কী দরকার তার, তা জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো, 'জীবিত থাকলেই মানুষ, মরে গেলেই মৃত। মৃতেরই প্রয়োজন শুধু সাড়ে তিন হাত, কিন্তু মানুষের প্রয়োজন পুরো পৃথিবী।'
অকাট্য যুক্তি। তবু তাকে বললাম, 'বেঁচে থাকতে মানুষের পুরো পৃথিবীর প্রয়োজন নেই বন্ধু। প্রয়োজন শুধু একটু নিখাদ ভালোবাসার। এই ভালোবাসার জন্য পৃথিবীটাকেই বিসর্জন দেওয়ার সাহস থাকা চাই শুধু।'
আমার কথা শুনে তার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি, বললো, 'ভা-লো-বা-সা! তাই বুঝি! ফুঁ...!'
Comments
Post a Comment