ভালোবাসার কাছে
শহিদুল ইসলাম আকাশ
মধ্যবয়সী পুরুষ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি সারা মুখে। মুখভর্তি পান। পানের রক্তরঙা পিচকিরি তাঁর সফেদ পাঞ্জাবীতে পড়ে দাগ লেগে যাচ্ছে, সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পান চিবোতে চিবোতে বললেন, 'সমস্যা নাই আলম সাব। কীভাবে গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে হয় তা আমার জানা। তারপর দেখবেন ঘোড়দৌড় কারে কয়!' স্যারের কথায় বাবার মুখে প্রশান্তির হাসি।
তাঁর এমন কথায় তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। নতুন স্যারের হাতে একজোড়া বেত, কখন হঠাৎ আমার গায়ে উঠে কে জানে! মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম, 'হে খোদা! বাঁচাও!'
প্রথম দিন কিছুই করলেন না তিনি। বললেন, 'আজ কোনো পড়ালেখা না। আজ আমরা শুধু গল্প করবো। এসো, গল্প শুরু করি।' তারপর দিনও, আমি পড়া শিখিনি বলে, আমাকে কোনো প্রকার শাস্তি দিলেন না। কাগজ দিয়ে নৌকা বানানোর খেলায় মেতে উঠলেন আমাকে নিয়ে। এই কাজে সে কী উৎসাহ তাঁর!
তারপরের দিন এবং তারপরেও, হাতে বেত থাকে তাঁর ঠিকই, কিন্তু সে বেত কখনো আমার গায়ে উঠেনি। এমনকী স্কুল কামাই করি কি পড়া না-শিখি, ঘরের লেখাজোকা সমাপ্ত না-করি__কখনোই না। আমার ছোট্ট মনে তাঁর জন্য এক ধরণের ভালোবাসা জন্মে গেলো ক্রমেই। তিনি আমার শিক্ষক, কিন্তু তারওচেয়ে বেশি হয়ে উঠলেন আমার একজন ভালো বন্ধু যেন।
একদিন তিনি আমাকে বললেন, '৫০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে তোমার রোল নাম্বার তো ৪০। একদম পেছনের বেঞ্চে বসতে হয় তোমাকে। এতে তোমার খারাপ লাগে না?' কোনো জবাব দিলাম না আমি। বললেন, 'আরেকটু ভালো করে পড়ালেখা করলে, আরেকটু মনোযোগী হলে, তুমিও প্রথম সারিতে বসতে পারবে। এসো, আমরা চেষ্টা করে দেখি, প্রথম সারিতে আমাদের দখল কী করে করা যায়। হোক বা না-হোক চেষ্টা তো করা যায়, কী বলো? এসো এখন থেকেই যুদ্ধ শুরু করে দিই।'
স্যারের উৎসাহে আমি চেষ্টায় লেগে গেলাম। স্যারের সীমাহীন আন্তরিকতায় পরের বার্ষিক পরীক্ষায় ৪০ থেকে এক লাফে আমি ১ হয়ে গেলাম। ক্লাস ক্যাপ্টেন। স্কুলের সব শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী আমার এমন ফলাফলে অবাক হয়ে যেতে বাধ্য হলো। অবাক হলো আমাদের পরিবারের সবাইও।
এরপর থেকে প্রতিটি ক্লাসে আমার রোল ১ থেকে আর সরে না। একটা গাধা ঘোড়া বনে গেলো। সেই ঘোড়া, যে প্রতিনিয়ত পড়ালেখার দৌড়ের উপর থাকতে চায়। সে যে কী ঘোড়দৌড়!
একদিনের কথা। তখন আমার এসএসসি পরীক্ষা চলছে। প্রতিটি বিষয়ে আমি ফুলমার্কের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। স্যারের খুশির অন্ত নেই, খুশির অন্ত নেই আমাদের পরিবারেও। সেই সময় একদিন স্যারের কাছে পড়তে বসেছি, বাবা এসে বসলেন পাশে। স্যার বাবাকে বললেন, 'আপনার ছেলে কেমন উন্নতি করছে দেখছেন তো?' বাবা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। স্যার বললেন, 'গায়ের জোরে, অর্থের জোরে, হুমকিদামকি ও আঘাত দিয়ে এই পৃথিবীতে কিছুই জয় করা যায় না। জয় করতে হলে, ভালোবাসতে জানতে হয়। এক ভালোবাসা দিয়েই অনায়াসে জয় করা যায় সব কিছু। ভালোসাকে যেমন সম্বল করে এগিয়ে যেতে হয়, বিশ্বাসও রাখতে হয় এই এক ভালোবাসাতেই। সেই ভালোবাসা আপনার সন্তানকে আমি দিতে পেরেছি। ভালোবাসার মোহন শক্তিতেই তার এই উন্নতি।'
রেজাল্ট বের হবার আগের দিন আমার উৎকণ্ঠার অন্ত নেই কিন্তু স্যার হাসিখুশি। বললেন, 'তুমি পাস করবে, এটা নিশ্চিত। সেই পাসও বলার মতোই হবে।' হলোও তাই। চারটি বিষয়ে লেটারমার্ক। পুরো বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নাম্বার আমারই। রেজাল্ট দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললাম।
আমার সেই স্যার গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর হয়। কিন্তু এখনো তাঁর কথা খুব করে মনে পড়ে আমার। তাঁর কাছ থেকে শিখেই তো আমি আজও এক ভালোবাসার কাছেই সমর্পন করি নিজেকে। ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো বোধের প্রতি সমর্পিত হইনি, সেই থেকে আজ অবধিও।
Comments
Post a Comment