মাটি ও মানুষের গল্প
শহিদুল ইসলাম আকাশ
'ঢাল নাই তলোয়ার নাই, বাঙালি আবার যুদ্ধ করে!' ইমাম সাহেব নামাজের পর মুসল্লিদের সাথে কথাটা বলে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। গত কয়েক জুমাতেও, খুতবার আগে, তিনি এই বিষয়ে দীর্ঘ বয়ান করেছেন। এই যুদ্ধে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট, তিনি পাকিস্তানের পক্ষে। এক জুমাবারে তিনি তাঁর বয়ানে বললেন, 'পাকিস্তানের খেয়ে পাকিস্তানের বদনাম, ঘোরতর অন্যায়। এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না।'
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করেছেন, তাঁর গ্রামে কেন এখনো আসেনি, এ নিয়ে তাঁর উৎকণ্ঠারও অন্ত নেই।
গ্রামের ছোকরা কিছু ছেলে 'জয় বাংলা' 'জয় বাংলা' বলে সংগঠিত হচ্ছে, মিটিংটিটিংও করছে__এসব দেখে ইমাম সাহেব অস্থির হয়ে উঠেন, নামাজের পর পাকিস্তানের জন্য দোয়া করেন তিনি।
ইমাম সাহেব সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছেন তাঁর কিশোরী মেয়েটিকে দেখে। এটুকু মেয়ে সারাদিনই রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনে। রাগে কয়েকবার তিনি মেয়ের গায়ে হাতও তুলেন। যদিও ইমাম সাহেবের সন্তানসন্ততি বলতে এই একটিই মেয়ে, স্ত্রীও গত হয়েছেন অনেকদিন আগে, মেয়েটিই তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন__তবুও। পাকিস্তান প্রশ্নে তিনি মেয়েটাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেন না, যাতে সে আর মুক্তির খবরটবর এসব না-শুনে। দেশ পাকিস্তানেরই থাকবে, তিনি বিশ্বাস করেন, এই দেশ কখনোই বাঙালিরা স্বাধীন করতে পারবে না।
ইমাম সাহেব অধীর হয়ে উঠেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই গ্রামে আসতে আর কতো দেরি? তাঁর আর তর সয় না যেন।
ইমাম সাহেবের এই অপেক্ষার অবসান হয় অতঃপর। তারপর একদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই গ্রামে আসে। ইমাম সাহেবের মসজিদের পাশে খোলা মাঠে ক্যাম্প করে তারা। ইমাম সাহেব সকাল বিকাল সেই ক্যাম্পে যান। গ্রামে কারা কারা মুক্তিযুদ্ধ করছে, কারা কারা বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলছে__সেই সব তথ্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে নিয়মিতই পৌঁছে দিতে লাগলেন তিনি।
তার তার দেওয়া তথ্য নিয়ে গ্রামের অনেককেই ক্যাম্পে এনে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। ইমাম সাহেব এসব দেখেন, আর বলেন, যুদ্ধের ময়দানে সবই জায়েজ__সবই।
এক রাতে ইমাম সাহেব ক্যাম্পের সব পাকিস্তানি সেনাদের তাঁর বাসায় খাওয়ার দাওয়াত করেন। এক সপ্তাহ আগে থেকেই এক এক করে খাবারদাবারের বিশাল আয়োজন করে রেখেছিলেন তিনি। পাকিস্তানি সেনারা সবাই আসলো। খেতে বসা পাকিস্তানি সেনাদের সামনে যখন ইমাম সাহেবের মেয়ে এক এক করে সব খাবার এনে রাখছিলো, তখন একজন সেনা ইমাম সাহেবের কাছে জানতে চাইলো, 'ইয়ে কৌন হ্যায়?' ইমাম সাহেব বললেন, 'মেরি বেটি'। অন্য একজন সেনা তাঁর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, 'খুবসুরত লাড়কি, বহুত খুব'।
খাওয়াদাওয়া শেষে অনেক রাত পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের সাথে আড্ডা দিলেন তিনি। বললেন, 'যুদ্ধ চালিয়ে যান আপনারা, একজনও যেন বেঁচে না-থাকে। ওরা বলে কিনা মাটির ইজ্জতের লড়াই, মাটির আবার ইজ্জত কিরে! সবাইকে মেরে ফেলবেন আপনারা।' ইমাম সাহেবের কথা শেষ হলে একজন পাকিস্তানি সেনা জবাব দেয়, 'কৌয়ি নেহি বাঁচেগা, মরেগা জরুর'।
এক সময় যখন পাকিস্তানি সেনারা যাওয়ার জন্য প্রস্ততি নিচ্ছিলো, তখন তাদের প্রধান সেনা ইমাম সাহেবের মেয়েকে ডাকতে বললেন। ইমাম সাহেব জানালেন, 'মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে'। অন্য এক সেনা সদস্য মেয়েকে ডেকে তুলতে বললেন, ইমাম সাহেব মেয়েকে ডাকতে ঘরের ভেতরে গেলেন। ঘুম ঘুম চোখে ইমাম সাহেবের মেয়ে বের হয়ে এলে, একজন সেনা মেয়েটির হাত ধরে টেনে নিয়ে, ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, কয়েকদিন পরে ক্যাম্পে এসে ইমাম সাহেব যেন তাঁর মেয়েটিকে নিয়ে আসে।
পাকিস্তানি সেনারা ইমাম সাহবের প্রিয়তম সন্তান, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন কিশোরী মেয়েটিকে নিয়ে গেলো।ঘটনার আকস্মিকতায় ইমাম সাহেব অবাক হয়ে গেলেন। মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বাধা দিলে, একজন সেনা ইমাম সাহেবের বুকে সজোরে লাথি দিয়ে বসে। ইমাম সাহেব মেয়েটির একটি হাত ধরে রাখেন তবুও। একটা সময় অন্য এক সেনা ইমাম সাহেবের বুকে একের পর গুলি চালাতে লাগলো। লুটিয়ে পড়েন তিনি।
লুটিয়ে পড়েও মাটিতে ভর দিয়ে, মাটিকে আশ্রয় করে, ইমাম সাহেব আবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে লাগলেন__সেই মাটি, আমৃত্যু যে মাটির বিরোধীতা করে গেছেন তিনি!
Comments
Post a Comment