প্রেমের সৌধ

শহিদুল ইসলাম আকাশ


'নাম কী তোমার?' জানতে চাইলাম আমি।

বারো-চৌদ্দ বছরের কিশোর। জীপগাড়ির হেলপার। চট্টগ্রামে যে গাড়ি 'চাঁন্দের গাড়ি' নামে সমাধিক পরিচিত। এসব গাড়ির বেশিরভাগই বেশ পুরোনো, পুরোনো বলেই জীর্ণশীর্ণ। ফিটনেসও নড়বড়ে, অনুমোদনও নেই। অনেক গাড়ির ব্রেকও কাজ করে না, তবু গাড়িগুলো রাস্তায় চলে। চলার সময় এতো দ্রুত চলে যে, যেন পৃথিবীর মাটিতে নয়, ভিনগ্রহের মাটিতেই চলছে। এ কারণেই হয়তো এসব গাড়িকে 'চাঁন্দের গাড়ি' বলে লোকে। এইসব গাড়িতে আগে মানুষ যাতায়াত করতো। এখন ইট, বালি, গাছ এসব বোঝাইয়ের কাজে ব্যবহার হয় বেশি।

কিশোর হেলপার একটু আগেও গাড়ি থেকে ইট নামাচ্ছিলো, নামানো শেষে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, আমার কথাশুনে ঈষৎ হেসে সে বললো, 'শাহজাহান'।

বললাম, 'অনেক বড় একজন রাজার নামে নাম তোমার। সেই রাজার কথা কি তুমি জানো?'

তার বিস্ময়, 'কন কী! আমার নামে একজন রাজা আছিলো!'

বললাম, 'হ্যাঁ। সম্রাট শাহজাহান। পঞ্চম মোগল সম্রাট ছিলেন তিনি।'

সে বললো, 'শম্রাট আবার কী?'

আমি বললাম, 'শম্রাট না, সম্রাট। সম্রাট মানে রাজা।'

তার বিস্ময় যায় না, বললো, 'হেই কী করতো?'

জবাবে বললাম, 'একটানা ৩০ বছর একটা উপমহাদেশ শাসন করেছেন তিনি।'

'কী কন বুঝি না। উপমহাদেশ কারে কয়?' তার ফের বিস্মিত প্রশ্ন।

বললাম, 'একসাথে অনেকগুলো দেশ। তাঁর গল্প শুনবে?'

সে বললো, 'সময় তো নাই। কইতে যহন চাইতাছেন, কন দেহি, হুনি।'

সে বুঝবে কিনা জানি না, তবু বলাম, 'সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসতেন। এতো ভালোবাসতেন যে, স্ত্রীর জন্য তিনি গড়ে তুললেন অমর এক সৌধ। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিলো মমতাজ, স্ত্রীর নামের সাথে মিল রেখেই তিনি সে সৌধের নাম রেখেছিলেন__তাজমহল। ২১ বছর ধরে এর নির্মাণকাজ চলে।'

কিশোর আমার কথায় কিছু বুঝলো বলে মনে হয় না। তবু আমি প্রলাপের মতো বলে যাচ্ছিলাম। চারপাশের মানুষকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই নিজে থেকে আলাপ জুড়ে বসি, যদি নতুন কিছু জানতে পারি__এই আশায়। এও তারই অংশ। আমার কথাশুনে কিশোর ছেলেটা বললো, 'কী বানাইছে কইলেন?'

বললাম, 'সৌধ। বাড়ি।'

সে বললো,  'হে রাজা আছিলো বলেই অনেক বড় একটা বিল্ডিং বানাইতে পারছে। আমার তো টেহাপয়সা নাই, আমারে এসব কইয়া লাভ কী কন।' তারপরেই বললো, 'যাই সাব। ড্রাইভার ভাইয়ে গাড়ি ছাড়বার সময় হইতাছে মনে হয়।'

ক্ষণপরেই গাড়ি ছেড়ে দিলো। কিশোর ছেলেটা লাফ দিয়ে গাড়ির পেছনের বাম্পারে দাঁড়িয়ে গেলো। একটু পরে গাড়িটা দূরে মিলিয়ে গেলো।

আমিও পাশ ফিরলাম। পাশ ফিরে আসতে আসতে মনে মনে প্রার্থনা করলাম, 'একদিন যখন এই কিশোর ছেলেটা অনেক বড় হবে, যখন তার জীবনেও আসবে কোনো অপরূপ নারী__সেই দিন তাদের পরস্পরের ভালোবাসার যেন কোনো কমতি না হয়। সম্রাট শাহজাহানের মতো কোনো অভিজাত তাজমহল নাই বানাতে পারলেও, সে যেন তার মনের মণিকোঠায় গড়ে তুলতে পারে প্রেমের অনন্য কোনো সৌধ__যে সৌধ তাজমহলের শোভার চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না কখনো।

Comments