অন্ধকারের দিন
শহিদুল ইসলাম আকাশ
মাজেদা বেগম বললেন, 'এই এইটুকুন থাকতে ওর বাপ মারা যায়। এহন যদি হে যুদ্ধে যায়, যুদ্ধে যদি তার কিছু একটা হইয়া যায়__তয় আমি বাঁচমু কী লইয়া ক?' বলেই সুলেখার চোখের দিকে তাকালেন, সুলেখার চোখের গভীরে তাকিয়ে আরিফের জন্য সুলেখার উৎকণ্ঠাও বুঝার চেষ্টা করলেন তিনি হয়তো।
পনেরো বছর বয়সে মাজেদা বেগমের বিয়ে হয় পাশের গ্রামের জমিদার বাড়ির একমাত্র পুত্র আব্দুল আজিজের সাথে। আজিজ তখন বাইশ বছরের টগবগে যুবক। কিন্তু বিয়ের পর দশ বছর কোনো সন্তানসন্ততি হয় না, মাজেদা বেগমের অসহায়ত্বের অন্ত থাকে না। কোনো কোনো রাতে তিনি স্বামীকে তাঁর এই অসহায়ত্ব প্রকাশও করেন, বলেন, 'আপনে আবার বিয়া করেন।' আব্দুল আজিজ মাজেদা বেগমকে তখন কাছে টেনে নেন, বুকে জড়িয়ে মাজেদা বেগমের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, 'সব আল্লাহপাকের ইচ্ছা। তাঁর উপর কারো কোনো হাত নাই। একদিন হইবো নে, এতো অধৈর্য হও ক্যান?'
মাজেদা বেগম ধৈর্য রাখতে চেষ্টা করেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর, বিয়ের বারো বছরের মাথায়, এই অপেক্ষার অবসানও হয়__মাজেদার গর্ভে আসে সন্তান। জন্ম হয় পুত্রসন্তানের। পুত্রকে কোলে নিতে গিয়ে মাজেদার দিকে তাকালেন আব্দুল আজিজ, বললেন, 'তোমারে কইছিলাম না বউ, সব আল্লাহপাকের ইচ্ছা।' মাজেদা বেগম আনন্দে হাসেন, বলেন, 'পুলার নাম রাখবেন না?' আব্দুল আজিজ এক মুহূর্তও না ভেবে বললেন, 'হ; আমাগোর পুলার নাম হইলো গিয়া 'আরিফ'।' যেন পুত্র হবে তা আব্দুল আজিজ আগেই জানতেন, তাই নামও ঠিক করে রেখেছিলেন। পুত্রের নাম বলেই ছুটে গেলেন মৌলভী খুঁজতে, আযান দিতে হবে যে। স্বামীর পাগলামি দেখে সুখে বুকটা ভরে উঠে মাজেদার।
আরিফের জন্মের পর মাজেদার জীবনটা স্বপ্নের ঘোরের মতো বড় আনন্দে অতিবাহিত হতে লাগলো। কিন্তু এই সুখও বেশিদিন সইলো না। স্বামী আব্দুল আজিজ হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিন যায়, মাস যায়; আব্দুল আজিজ আর সুস্থ হয়ে উঠেন না। তারপর এক সময় মৃত্যুর কাছে হার মানতেই হলো তাঁকে। আরিফের বয়স তখন মাত্রই আট বছর।
এসব কথা মাঝেমাঝে সুলেখার সাথে বলেন মাজেদা। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন। আজও বললেন। সাথে আরিফের যুদ্ধে যেতে চাওয়ার কথাও। সুলেখা বললো, 'আপনের পুলা যুদ্ধে যাইতে চায় তো যাইবো। দেশে যুদ্ধ লাগছে, এই যুদ্ধে তো আমাগোর জিতন লাগবই।' মাজেদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, সুলেখার মতো এইটুকু মেয়েও যুদ্ধের পক্ষে কথা বলে! আশ্চর্য! তিনি মনে মনে বলে উঠেন, 'এই অল্পবয়সী পুলামাইয়াগো হইলোডা কী! খালি দেশ আর দেশ! সব্বাই মিলা পাগল হইয়া যাইতেছে নাকি!'
মাজেদা বেগমের নিষেধ সত্ত্বেও আরিফ যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্বান্তে অটল রইলো। এক রাতে আরিফ এসে মায়ের পায়ের কাছে বসলো, বললো, 'মা, এই দেশটা তো আমাগোরই, দেশটারে রক্ষা করতে হইবো না?' মাজেদা বেগম কী বলবেন ভেবে পান না, একটা বোবা কান্না তাঁর গলায় এসে আটকে থাকে। মার নিরবতা দেখে আরিফ বললো, 'কথা কও না ক্যান? তুমি যদি আমারে হাসিমুখে যুদ্ধে যাইতে না দাও, আমি দেশটারে স্বাধীন করমু কী করে কও?'
একটা সময় সন্তানের অকৃত্রিম আগ্রহকে আর উপেক্ষা করতে পারলেন না মাজেদা। বললেন, 'যা; দেশটারে স্বাধীন কইরা তবেই ফিরে আইবি।'
যুদ্ধে যাওয়ার আগের রাতে চুপিচুপি আরিফ সুলেখার সাথেও দেখা করতে গেলো। এক চিলতে জানালার ওপাশে সুলেখা, এপাশ থেকে আরিফ বললো, 'কালই যাইতাছি। দোয়া রাইখো।' জবাবে সুলেখা বললো, 'যান, দেশ স্বাধীন করতে পারলে, ফিরে আইবার সময় একখান লাল-সবুজ পতাকা নিয়া আইবেন।' রাতের সুনসান নিরবতায় আরিফ কিছুক্ষণ নিরব হয়ে থাকলো, তারপর বললো, 'আর যদি ফিরে নাই আইতে পারি?' এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না সুলেখা, জানালার ওপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে। এপাশেও মৃতের মতো নিরবতা।
আরিফ যেদিন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হলো, সেদিন সাথে মাজেদা বেগমও ষোলশহর রেলস্টেশন পর্যন্ত আসেন। তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন প্রিয় পুত্র তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে এই দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিতে__এ যে একই সাথে বড় গৌরবের, গাঢ় বিচ্ছেদেরও__মাজেদা বেগম কি এই ভার বইতে পারবেন!
ট্রেনে উঠতে যাওয়ার আগে মাজেদা বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করলো আরিফ, বললো, 'যাইতাছি মা। নামাজ পইরা দোয়া রাইখো, এ দেশ য্যান স্বাধীন হয়।' বলেই ট্রেনে উঠে গেলো আরিফ। ট্রেন ছাড়লো, ক্ষণপরেই দূরে মিলিয়ে গেলো, তবু পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন মাজেদা বেগম।
হঠাৎই পুরো জংশন যেন নিথর হয়ে গেলো। প্রখর রৌদ্র; তবু যেন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। হাজার মানুষের ভীড়; তবু যেন কোনো খাঁ খাঁ বিরান মরুভূমি।
মাজেদা বেগমের বুকেরই মতন।


Comments
Post a Comment