কী এক মায়া!

শহিদুল ইসলাম আকাশ
এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আমার এক স্বজনের মৃত্যুর খবর পাই। ওই রাতেই রওয়ানা দিলাম ঢাকার উদ্দেশে। শুক্রবার বাদ জুমা তাঁর জানাজা নামাজ শেষে যখন তাঁর শব আজিমপুর কবরস্থানে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, পিছু পিছু আমিও গেলাম।

এই কবরস্থানের পাশ দিয়ে আমি অনেকবার গেছি, কখনোকখনো উঁকি দিয়ে দেখেছি, এবারই প্রথম ভেতরে প্রবেশ করলাম।

দেখি, সারি সারি হাজার হাজার কবর। কিছুক্ষণ পরপরই নতুন নতুন মৃত নিয়ে আসা হচ্ছে, তাঁদের দাফন করা হচ্ছে। এক একটা দাফনকাজ সম্পন্ন হচ্ছে আর চারপাশে বাতাস ভারী হচ্ছে সমবেত কান্নার রোলে। কেউ কেউ আসছেন জিয়ারত করতে, কেউ কেউ তাঁদের স্বজনের কবরে লাগিয়ে দিচ্ছেন নানান জাতের ফুলের গাছ, কেউ কবরের গায়ে পানি দিচ্ছেন, সাইনবোর্ড লাগাচ্ছেন। এসব দেখে জায়গাটার প্রতি সম্মোহন জেগে গেলো আমার।

পরদিন বিকেলবেলা আবার গেলাম। স্বজনের কবরে জিয়ারত করা শেষে ঘন্টাখানেক ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কবরস্থানের কর্মচারী, জিয়ারত করতে আসা মানুষ, এবং মৃতদেহ নিয়ে আসা শোকসন্তপ্ত নানান জনের সঙ্গে কথা বললাম। আজও একবার গেছি। সন্ধ্যের একটু পরে। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে পুরো কবরস্থানে এলইডি বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঝলমলে আলোয় কবরগুলোর গায়ে অপূর্ব নকশা তৈরি হয়ে আছে, যেন কোনো অপার্থিব জগত__যে জগতের সাথে যেন এই পৃথিবীর কোনোই সম্পর্ক নেই।

এখানেওখানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ খেয়াল হলো, একজন চল্লিশোর্ধ ব্যক্তি, কবর জিয়ারত করছেন আর শব্দ করে কাঁদছেন। থমকে গেলাম আমি।

কবরটার এক পাশে টাঙানো সাইনবোর্ডে দৃষ্টি গেলো। সাইনবোর্ডের উপরের অংশে ছোট করে লেখা, 'আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল ক্বুবুর', তার ঠিক নিচে বড় করে লেখা, 'জুলিয়া আক্তার ছায়া, জন্ম: ১৫/১০/২০০৬, ভোর ৫ ঘটিকা; মৃত্যু: ২০/০১/২০০৭, সন্ধ্যা ৭ ঘটিকা'। এর একটু নিচে লেখা: 'আমাদের অতি আদরের কন্যা।' একদম শেষে লেখা, 'আল ইমরান জীবন ও সুমি ইসলাম; কন্যার পিতা-মাতা।'

আমি ক্রন্দনরত মানুষটির পিঠে হাত রাখলাম। তাতেও তার ভাবান্তর নেই। তিনি কেঁদেই যাচ্ছেন। একটা সময় তিনি পিছু ফিরে তাকালেন। চেনা নেই জানা নেই, অথচ আমাকেই অতি নিকটজনের মতো জড়িয়ে ধরে আরো জোরে শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন।

তাঁকে নিয়ে আমি কবরের অদূরে বৈঠকখানার মতো একটা জায়গায় বসলাম। জানতে চাইলাম, তিনিই কি আল ইমরান জীবন, মৃত শিশুকন্যার বাবা। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে উপরনিচ মাথা নাড়লেন তিনি, বললেন, 'হ্যাঁ'।

তারপর তাঁকে যেন কথায় পেয়ে বসলো। খানিক পরপরই চোখ মুছছেন আর বলেই যাচ্ছেন: 'মাত্র ৩ মাস ৫ দিন বয়সেই আমার মেয়েকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো। আমার মেয়েটা জানলোই না যে, মধ্যরাতে আকাশে কী অপূর্ব এক চাঁদ উঠে, নক্ষত্রের বাগান সাজে; সেই একই আকাশে আবার কেমন সুন্দর করে ভেসে বেড়ায় মেঘ, বৃষ্টি ঝরে__কিছুই দেখলো না মেয়েটা! নদী দেখলো না, নদীর বয়ে যাওয়ার শব্দটাও শোনা হলো না তাঁর!'

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু থামলেন তিনি। আবার বলা শুরু করলেন, 'আমার মেয়েটা প্রিয়তম পুরুষের সাহচর্য কেমন উষ্ণ, জানলো না তাও! প্রিয় মানুষের বুকে মুখ রেখে সমস্ত ক্লান্তি অপনোদনের অনুভূতি থেকেও বঞ্চিত হতে হলো তাকে! কোনো মানে হয়!'

বললেন, 'কী এক মায়ার নাম, এই জীবন! মায়ার সাথেই আমাদের প্রত্যেকের হাতকড়া। আমার মেয়েটা সেই হাতকড়া লাগাবার আগেই, ভেঙে গেলো কেন!' 

আমি তাঁকে কী সান্ত্বনা দেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবু বললাম, 'আপনার মেয়ে যে জগতে গেছে, আমাদের প্রত্যেকেরই সেটাই তো আসল জগত। সেই জগতের মানুষ পৃথিবীর মানুষের মতো দীর্ঘশ্বাসকেই নিঃশ্বাস বলে ভুল করে না কখনো।'

তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চলে যেতে সমুখে পা বাড়ালেন। একটু থেমে পিছু না ফিরেই বললেন, 'আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন, যাই'।


Comments