শূন্যস্থান

শহিদুল ইসলাম আকাশ


প্রতিদিন সকালে আপনার বাসায় পত্রিকা দিয়ে যায় যে হকার, তার নাম কি জানেন? এই প্রশ্ন আমি বেশ কয়েকজনকে করেছি। কারো কারো উত্তর ছিলো, 'না।' কেউ বলেছেন, 'আমি তাকে দেখিও না, আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই পত্রিকা দিয়ে চলে যায়। মাস শেষে বিলটা সে বউ বা কাজের মানুষ কারো কাছ থেকে নিয়ে যায়।' কেউ কেউ তো চোখ কপালে তুলে বলেছেন, 'এটা কেমন প্রশ্ন! যত্তোসব পাগলের প্রলাপ।'

জীবন আমাদের এক দুর্লভ প্রাপ্তি। এই এক টুকরো জীবনে দৈনন্দিন আমাদের সাথে মিশে থাকা মানুষগুলোকে কতো সহজেই না আমরা তুচ্ছ করি।

এক সময় বাজার করাকে আমার মনে হতো বিরক্তির কাজ। এখনো তাই আছে। পার্থক্য হলো, তখন নিজে না করলেও মাঝে মাঝে বাসার কেউ না কেউ করে ফেলতো, কিন্তু এখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকেই বাজারে গিয়ে বাজার করতে হয়। কাজের মানুষ রাখার মতো সামর্থ্য আমার নেই।

আমার পার্শ্ববর্তী বাজারে দশ বারো বছরের একটা ছেলে তরিতরকারি বেঁচে। প্রায় নিয়মিতই আমি সেই কিশোরের কাছ থেকে সদাই করি। দরদাম করি না। সেও আমার কাছ থেকে এক টাকাও বেশি নেয় না। উল্টো কখনো তার তরকারি খারাপ হলে সে বলে দেয়, 'এটা ভালো হবে না, অন্য কারো কাছ থেকে নিয়ে নেন।' আমি তার সততায় অভিভূত হই।

তার সাথে মাঝে মাঝে আমি আলাপ জুড়ে দেই। লেখাপড়া না-করে এই বয়সে সে কেন এ ব্যবসায়ে এসেছে, বাসায় কে কে আছে__এসব। বা আজ ব্যবসা কেমন হচ্ছে, যখন তার কিছু টাকা জমবে, সেই টাকা দিয়ে সে কী করবে__এসবও।

সে জানায় তার বাবা নেই। গত হয়েছেন বছর তিনেক আগে। ঘরে মা এবং ছোট এক বোন আছে। নিজে লেখাপড়া করতে না-পারার আক্ষেপটা সে ছোট বোনটাকে অনেক লেখাপড়া করিয়ে দূর করতে চায়। তার মতো তার বোনকে যাতে হাটেবাজারে এমন ঘুরে ঘুরে তরকারি বেছতে না-হয়। বোনটাকে সে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখে।

এতো কথা তার সাথে আমার হয়েছে, কিন্তু কখনোই জানা হয়নি তার নাম কী এবং কোথায় সে থাকে। দুর্লভ জীবনের এই সম্পর্কটার ব্যাপারে আমি এতো উদাসীন হলাম কীভাবে! ইদানীং ব্যাপারটা আমাকে বেশ পীড়া দিচ্ছে।

কারণ, গতো কয়েক মাস ধরে তাকে বাজারে আর তরকারি বেছতে দেখি না। প্রতিবারই বাজারে গেলে তার খুঁজ করি, কিন্তু পাই না।

প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না, তার জায়গায় অন্য একজন তরকারি বেছে এখন। আমি তার কাছ থেকেও এখন নিয়মিত তরকারি কিনি। তার নামধাম জেনে রাখার ভুলটা আর করিনি। কিন্তু যতোবারই তার কাছ থেকে তরকারি কিনি, প্রায় প্রতিবারই আমি সেই কিশোরের প্রসঙ্গ তুলি। সে হাসে আর বলে, 'এই এক ব্যাপার আর কতোবার বলবেন স্যার? আমিও যদি এমনি করে কখনো উধাও হয়ে যাই, আমাকেও কি আপনি এমন মনে রাখবেন?' বলে, 'আপনি বড়-বেশি মনে রাখেন স্যার। মনে রাখার মতো পাপ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই।'

এ মানুষটিও হয়তো সে কিশোরের মতো একটা সময় আর এখানে তরকারি বেছতে আসবে না। তখন তার জায়গায় এসে বসবে অন্য আরেকজন। কিংবা হয়তো আমিই অন্য কোথাও গিয়ে থিতু হয়ে বসবো। সেখানে অন্য কারো কাছে তরকারি কিনতে কিনতে হয়তো আবারো সেই কিশোরের গল্প জুড়ে বসবো। তরকারি মাপতে মাপতে সেও হয়তো বলে বসবে, 'আপনি বড়-বেশি মনে রাখেন স্যার। মনে রাখার মতো পাপ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই।'

প্রকৃতি শূন্যস্থান পূরণ করে দেয় ঠিকই, কিন্তু সব শূন্যস্থান নয়। মনের শূন্যস্থান পূরণ করার ক্ষমতা প্রকৃতির নেই।

Comments