বন্দী পাখির ডানায়

শহিদুল ইসলাম আকাশ


বোকাসোকা ধরণের লাজুক কিশোরী মেয়ে। বেণী করা চুলে নানান রঙের রীবণ, দুই হাত জুড়ে রঙবেরঙের চুড়ি, কপালের ভাঁজে উজ্জ্বল টিপ, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। যখন কথা বলে, তখন যেন তার চোখেমুখে ফুটে উঠে অনিন্দ্য গোলাপ। যখন হাসে, পাহাড়ি নদীর বয়ে যাওয়ার মতো শব্দ উঠে, নৈঃশব্দ্যে। তাকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, তার এই সাজগোছের আড়ালে কী এক গভীর দুঃখ সে পুষে রাখে।

আমিও তখন অমল কিশোর। খুব ডানপিটে ছিলাম। সারাক্ষণই খেলাধুলো নিয়ে পড়ে থাকতাম, স্কুলে যেতে চাইতাম না। বড় ভাই ধরেবেঁধে স্কুলে দিয়ে আসতো, সুযোগ পেলেই আমি পালিয়ে যেতাম। আমার এহেন কর্মকাণ্ডে বাসার সবাই ভীষণরকম চিন্তিত। বাবা প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, 'এই ছেলেটাকে দিয়ে পড়ালেখার কিছুই হবে না।' কী করা যায়, ভেবে পাচ্ছিলেন না।

শহরে বাবার ব্যবসা আছে। প্রতি বৃহস্পতিবার শহর থেকে গ্রামে আসেন, শনিবার আমরা ঘুম থেকে উঠার আগেই আবার শহরে চলে যান তিনি।

এক বৃহস্পতিবার রাতে বাবা এসেই আমাকে ডাকলেন, বললেন, 'তুমি ঠিকমতো পড়ালেখা করছো না। আমি ঠিক করেছি, তোমাকে আর স্কুলে পড়াবো না। শহরে আমার বাসার কাছাকাছি একটা মাদ্রাসা আছে, সেখানেই তোমাকে ভর্তি করে দেবো। শনিবারে আমার সাথে তোমাকেও শহরে যেতে হবে।' বাবার আদেশ না মানার মতো সাহস আমার ছিলো না, ভীষণ ভয় পেতাম বাবাকে।

পরের শনিবারে বাবার সাথে শহরে চলে যেতে হলো। দু'দিন পরেই 'জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া' নামের মাদ্রাসাতে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হই। আগেরদিনই পাঞ্জাবি, পায়জামা ও টুপি কিনে দেওয়া হয়। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে, আমারও হলো একই দশা। কয়েকদিনেই আমার একই স্বভাবের এক বন্ধু জুটে গেলো, সেও আমার মতো পড়ালেখায় অমনোযোগী।  সকালে মাদ্রাসার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হই ঠিকই, কিন্তু মাদ্রাসায় যাওয়া হয় না, বন্ধুকে নিয়ে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে চলে যাই ষোলোশহর জংশনে। ক্লাস ছুটি না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকি। বাবা কিছুই জানতে পারতেন না। ছয় মাস পরে বাবা যখন আমার 'কীর্তি' জানতে পারলেন, আবার পাঠিয়ে দিলেন গ্রামে।

ওই মাদ্রাসায় পড়াকালীন মাত্র ছয় মাসে ষোলোশহর জংশনে কাটানো সময়ের কথা। ট্রেন আসে, ট্রেন যায়; অবাক হয়ে দেখি। কিছুদিনের মধ্যে চলন্ত ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠে যাওয়ার কৌশলও রপ্ত করে ফেলি। আত্মঘাতী কৌশল, কিন্তু তখন যেন সে এক মজার অভিজ্ঞতাই। একদিন মাদ্রাসার সামনে দিয়ে, দোহাজারি থেকে আসা, চলন্ত ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠে গেলাম। ষোলোশহর জংশনে এসে আবার লাফ দিয়ে নামতেই সেই কিশোরী মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে গেলো। চেঁচিয়ে উঠলো সে, বললো, 'এই কী করো! ট্রেইন থাইকা অমন করে লাফ দেও ক্যান! মরবা নি!'

পরবর্তীতে এই কিশোরীর সাথে আমরা দুই বন্ধুর একরকম সখ্যতা গড়ে উঠলো। তার নিজের কোনো ভাই নেই, আমাদের সে ভাই বলে ডাকতো। আমাদের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়, তাই আমরাও তাকে 'আপা' সম্বোধন করতাম। তার সাথে দেখা করে কথা বলার জন্য আমরা দুই বন্ধুও মুখিয়ে থাকতাম খুব।

রেললাইনের পাশে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে সে। সাথে বাবা ও সৎ মা। পাঁচ বছর বয়সেই মাকে হারায়। বাবা আবার বিয়ে করে। অভাবের সংসার। বাবা একটা বাসাবাড়ির দারোয়ান, মা গার্মেন্টসে চাকরি করে।

একদিন জানতে চাইলাম, 'তোমাকে দেখে মনে হয় না, তোমাদের কোনো অভাব আছে__তোমার এইসব কাপড়চোপড়, চুলের রীবন, হাতভরা চুড়ি, টিপ, লিপস্টিক __এগুলো কে কিনে দেয়?'

জবাবে সে যা বললো, ওইটুকু বয়সে আমাদের তা বোঝার কথা না, তবু শুনে আমাদের ভেতরটা কেমন জানি হাহাকারে ভরে উঠলো। বললো, বাবা ও সৎ মা অনেক রাত পর্যন্ত কাজে থাকে। এই ফাঁকে তার সৎ মায়ের আধবয়সী এক ভাই আসেন তাদের বাসায়। প্রতিবার কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসেন তিনি। এসেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। তার এসব ভালো লাগে না। বাঁধা দিতে গেলে গায়ে হাত তুলেন। একবার তো ব্যথায় চিৎকার করতে গেলে, তার মুখ চেপে ধরে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। সেবার অনেকক্ষণ বেহুশ হয়ে থাকতে হয় তাকে। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে, হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। বললো, 'তোমাগো লগে আমারে নিইয়া যাইতে পারবা? কও না ক্যান, পারবা নি?' আমরা দুই বন্ধু নীরব হয়ে থাকি, যেন সমস্ত জগতসংসার থমকে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়।

বাবা যখন আমাকে পুনরায় গ্রামে এনে স্কুলে ভর্তি করে দেন, তখন আমার ছোট্ট মনে নিদারুণ এক শূন্যতা অনুভূত হতো প্রতিনিয়ত। কিশোরী মেয়েটি, যাকে 'আপা' বলে ডেকেছি__সেই শূন্যতা তার জন্যই, তা বুঝতে পারতাম খুব।

দিন যায়, মাস যায়; বছরের পর বছর যায়। ধীরে ধীরে আমিও সেই কিশোরীকে ভুলে যেতে থাকি ক্রমশ। মানুষের মতো ভুলে যেতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী পৃথিবীতে হয়তো আর দ্বিতীয়টি নেই। হয়তোবা তাও ঠিক নয়, মূলত কিছুই ভুলতে পারে না মানুষ, প্রতিনিয়ত ভুলে থাকার অভিনয়ের ক্ষমতাটুকুই মানুষের থাকে কেবল। বড়ই জটিল সমীকরণ।

এর প্রায় বছর পাঁচেক পর, মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ের আমার বন্ধুটিকে নিয়ে সেই কিশোরীর খুঁজে ষোলোশহর জংশনে যাই একদিন। পাঁচ বছরে অনেকখানিই বদলে গেছে জংশন। অনেকগুলো বহুতল ভবন দাঁড়িয়ে গেছে ততোদিনে। তাদের সেই সেমিপাকা বাসার জায়গাতেও উঠে গেছে ছয়তলা বসতবাড়ি। সেই সময়ের এক দোকানদারকে পেয়ে গেলাম। তাঁর কাছে তাদের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, 'হেরা তো এইখান তন গেছে ম্যালা দিন হয়। কই গেছে জানা নাই।'

এখনো মাঝেমাঝে সময় ও সুযোগ পেলে, জংশনের পাশ দিয়ে যাই। একটু থমকে দাঁড়াই। ব্যস্ত জংশনে মানুষের ভীড় ও কোলাহলের মধ্যেও, কৈশোরের সেই স্মৃতিগুলো ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করি। যে স্মৃতির অনেকখানিই জুড়ে আছে একটি দুঃখী কিশোরী মেয়ে।

তখন তার সরব উপস্থিতি টের পাই, তার সেই অসহায় আর্তি কানে এসে বাজে, 'তোমাগো লগে আমারে নিইয়া যাইতে পারবা? কও না ক্যান, পারবা নি?' বুকের ভেতর একটি বন্দী পাখি যেন ডানা ঝাপটায় তখন। পাখিটির সাদা ডানায় লেগে থাকে রক্তের লাল রঙ।

Comments

Post a Comment