রক্তের রঙ লাল

শহিদুল ইসলাম আকাশ

শ্রাবণ মাসের রাত। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরলাম। শরীরে সারাদিনের ক্লান্তি। রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুতেই, ঘুমে চোখ জুড়ে এলো। ঘুমিয়ে পড়লাম মুহূর্তেই। রাত বারোটার দিকে বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো। ঘুম ভেঙে গেলো। অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করতেই পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি আমার এক আত্মীয়ের প্রতিবেশী। গফুর নাম তাঁর। আমার সেই আত্মীয় হঠাৎ স্ট্রোক করেছেন, এখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি হাসপাতালে যেতে পারি কিনা জানতে চাইলেন।

ক্লান্তিতে শরীর বিছানার সাথে লেগে আছে, ঘুমে চোখ খোলাও কষ্টসাধ্য। বললাম, আমি সকালে গেলে হবে কিনা। জবাবে তিনি বললেন, 'আপাতত সমস্যা নেই। আপনার আত্মীয় এখন আশংকামুক্ত আছেন। বললেন, সকালে একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারলে ভালো হয়।'

পরদিন খুব সকালবেলা হাসপাতালে গেলাম। অবিরাম বৃষ্টি। এক মুহূর্তের জন্যও থামছে না। সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেমে হাসপাতালের গেট থেকে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই অনেকখানি ভিজে যেতে হলো। গিয়ে প্রথমেই আমার অসুস্থ আত্মীয়ের বেড খুঁজে নিয়ে তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। বললেন, এখন তিনি সুস্থ আছেন। তারপর যে মানুষটি আমাকে ফোন করেছেন, সেই গফুর সাহেবের কথা জানতে চাইলাম, তিনি কে? এখন কোথায়? আমার আত্মীয় বললেন, 'বলতে গেলে তিনি আমার কেউ-ই নন, শুধুই প্রতিবেশী। তিনি না থাকলে আমি মরেই যেতাম। দ্রুত যদি তিনি এসে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি না করতেন, এতোক্ষণে তোমাদেরকে আমার জানাজার জন্য প্রস্তুতি নিতে হতো। বড় ভালো মানুষ, গ্রামে সবার আপদবিপদে তিনিই এগিয়ে আসেন আগে।' বললেন, 'এখন তিনি আমার ঔষধ আনতে গেছেন।'

আমার সেই আত্মীয়ের স্ত্রী মারা গেছেন বছর দুই হয়। একমাত্র ছেলে জীবীকার তাগিদে দেশের বাইরে। এক মেয়ে আছে, সেও ঢাকায় শ্বশুর বাড়িতে। গফুর সাহেব না থাকলে সত্যি সত্যি হয়তো কিছু একটা হয়ে যেতেও পারতো তাঁর!

আমি হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। গফুর সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছি। ডাক্তাররা রোগীকে সব কথা বলেন না, রোগীর স্বজনদের কাছেই বিস্তারিত বলেন। আমার আত্মীয়ের স্বজন হিসেবে যেহেতু তিনিই ছিলেন, ডাক্তার কিছু বলেছেন কিনা জেনে নেওয়া জরুরি। সেই সাথে তাঁর সম্পর্কে আমার আত্মীয়ের মুখে যেটুকু শুনলাম, তাতে তাঁর সাথে কথা বলার ইচ্ছেও বেড়েছে।

দু'তলার বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখি, একজন পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে আসছেন। হাতে পলিথিনে মোড়ানো ঔষধ। ডানেবাঁয়ে তাকাবার সময় যেন তাঁর নেই। যেন তিনি হাঁটছেন না, দৌঁড়াচ্ছেন। মনে মনে বললাম, এই ব্যক্তিই কি গফুর?

আমার অনুমান সত্যি হলো। তিনিই, আমার আত্মীয়ের সেই প্রতিবেশী, যিনি গতরাতে আমাকে ফোন করেছেন। আমার অসুস্থ আত্মীয় আমরা পরস্পরকে পরিচয় করে দিলেন। কিছুক্ষণ পর গফুর সাহেবকে নিয়ে আবার হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।

তাঁর সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম। তিনি জানালেন, বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও তিনিই থাকেন এখন। দুই ছেলে আছে তাঁর। বড় ছেলে কাতারে কোন একটা কোরিয়ান কোম্পানিতে চাকরি করে, বউবাচ্চাও কাতারে থাকে। আরেক ছেলেকে ডাক্তার বানিয়েছেন তিনি, সে এখন ঢাকায় থাকে। ওখানে কোনো-এক শিল্পপতির মেয়েকে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর থেকে আর একবারও মা-বাবাকে দেখতে আসেনি। মাঝেমাঝে ফোনে কথাটথা হয়, টাকাপয়সাও পাঠায় কদাচিৎ। বলতে গিয়ে গফুর সাহেবকে একটুও চিন্তিত মনে হলো না। বললেন, 'মানুষের জন্য কাজ করি। ভালো লাগে বলেই করি। ছেলেরা ডাক্তার,  ইঞ্জিয়ার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা 'মানুষ' হতে পারেনি__অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেই দুঃখ ভুলে থাকতে চেষ্টা করি। সফলও হয়েছি।'

খানিক থেমে আবার বলতে লাগলেন, 'আজকাল অনেকেই ভুলে গেছে যে, মানুষের ইতিহাস, সভ্যতা আর সংস্কৃতি একদিনে গড়ে উঠেনি। গড়ে উঠতে লেগেছিলো হাজার হাজার বছর। কিন্তু তা নিশ্চিহ্ন করতে কয়েক সেকেন্ডও লাগার কথা না। এই সত্য মানুষ বোঝে না কেন? আমার ছেলেগুলোও এতোটা স্বার্থপর হলো কেন?'

গফুর সাহেবের কথা শুনে চমৎকৃত হলাম। এতো গুছিয়ে কথা বলেন মানুষটা, তখন নীরব শ্রোতা হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাঁর প্রতি আমার আগ্রহও দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।

আমার সেই আত্মীয় সেবার সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার পর অনেকবারই তাঁর বাড়িতে গেছি। যতোটা না আত্মীয়কে দেখতে, তারচেয়ে বেশি গফুর সাহেবের সাথে আলাপ জুড়ে দেওয়ার লোভে। ততোদিনে গফুর সাহেব সম্পর্কে আরো অনেক অজানা তথ্যই জানা হয়ে গেছে আমার। তিনি যে শুধু অসহায় অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান তা না, এলাকার কিছু প্রতিবন্ধী শিশুকে প্রতিদিন নিয়ম করে এক ঘন্টা পড়ান। বাল্যবিবাহ রোধেও সামাজিক সচেতনা গড়ে তুলতে পাড়ায় পাড়ায় ছুটে বেড়ান। তাঁর সম্পর্কে যতোই জানি, অভিভূত হই প্রতিবার। এই গফুর সাহেবরা যতোদিন বেঁচেবর্তে থাকবেন, চারপাশের স্বার্থান্ধ মানুষের ভীড়েও,  ততোদিন মানুষের হাজার বছরের এই যে ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এইসব ধ্বংস হবে না কখনোই। আমাদের নিরাশ হওয়ার কিছুই নেই।

পুনশ্চ:
গফুর সাহেবের ডাক্তার ছেলেটার সাথে একবার আমার দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই দেখার কথা না লিখলে এই লেখা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

ঢাকার নাম করা এক হাসপাতালের ডাক্তার তিনি। সেই হাসপাতালেই আমার পরিচিত একজন চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসা করতে করতে যিনি রীতিমত প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
কী একটা কাজে আমি তখন ঢাকায়। গফুর সাহেবের ছেলের সাথে দেখা করলাম। আমি নিজের পরিচয় দিলাম, সাথে তাঁর বাবার কথাও বললাম। তিনি আমার কথায় খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না, বললেন, 'ওসব শুনে কাজ নেই। কী জন্য এসেছেন বলেন?' বললাম, 'আপনাদের হাসপাতালে আমার পরিচিত একজন রোগী আছেন। তিনি এখন প্রায় নিঃস্ব হওয়ার যোগাড়। আপনি যদি তাঁর প্রতি একটু খেয়াল রাখতেন।'

হঠাৎ কী হয়, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, রেগে উঠে বললেন, 'অনেক টাকা খরচ করে ডাক্তার হয়েছি, আমি হাজী মোহাম্মদ মহসিন না। এই হাসপাতাল গরীবের হাসপাতাল না। টাকাপয়সা না থাকলে অন্যত্র নিয়ে যান।' বলে আবার চেয়ারে বসতে বসতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, 'যত্তোসব!' আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। বলার মতো কিছু ছিলোও না আমার।


একজন গফুর সাহেবের হৃদয় যতোটা প্রশস্ত, তাঁর সন্তানের হৃদয়ের ততোটাই দীনতা দেখে তাঁর সন্তানের প্রতি ঘৃণায় বুকটা ভরে উঠলো আমার।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিএনএর কথা বলা হয়, বলা হয়, ডিএনএ পূর্বপ্রজন্মের স্বভাবচরিত্র ও পরিচয় বহন করে। গফুর সাহেবের ডাক্তার ছেলের এমন আচরণে মনে হলো, চিকিৎসাবিজ্ঞান ভুল। ডিএনএ সবসময় পূর্বপ্রজন্মের স্বভাবচরিত্র বা পরিচয় বহন করে না। সবার রক্তের রঙই লাল, এর বাইরে রক্তের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই।






Comments

Post a Comment