একজন হেদায়েত
শহিদুল ইসলাম আকাশ
হেদায়েতের সাথে কথা বলে জানলাম, তাঁর এক মাস বয়সে তাঁকে এই কবরস্থানের গেটের বাইরের রাস্তা থেকে মকবুল চাচা নামের একজন, যিনি নিজেও এই কবরস্থানে কবর খোদাইয়ের কাজ করতেন, তাঁকে তুলে নেন। লালনপালন করেন। বুদ্ধি হওয়ার পর হেদায়েতকেও মকবুল চাচা নিজের সাথে কবর খোদাইয়ের কাজে লাগিয়ে দেন। মা-বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হেদায়েতের হয়নি, মকবুল চাচাই একই সাথে হেদায়েতের মা ও বাবার দায়িত্ব পালন করে গেছেন আমৃত্যু। মাঝেমাঝে হেদায়েতের বুকের ভেতরটা যন্ত্রণা করে উঠে, তাঁর আসল মা-বাবাকে দেখতে বড় ইচ্ছে জাগে তাঁর! সেই সব মুহূর্তে হয়তো সৃষ্টিকর্তার প্রতি অভিমানী হয়ে উঠেন তিনি। মনে মনে তখন তিনি হয়তো বলে উঠেন যে, এতোটা রহস্য এই সৃষ্টিজগতে না-রাখলেই কি হতো না!
এই কবরস্থানেই তাঁর খাকা-খাওয়া সবকিছু। কবরস্থানের বাইরে তাঁর নিজের আর কোনো আলাদা জগত নাই। বিয়েথাও করেননি। তাতে অবশ্য হেদায়েতের মনে কোনো দুঃখ নেই। ডাক পড়লে কবর খোড়ার কাজ করেন, বাকি সময় ২৭ একরের বিশাল কবরস্থানের চারদিকে আপনমনে ঘুরে বেড়ান। এই কবরস্থানের সাথেই তাঁর আজন্ম সখ্যতা, এই জীবন তাঁর বড় ভালোও লাগে। তিনি বললেন, এক মুহূর্তের জন্যও তিনি এই কবরস্থান ছেড়ে কোথাও যাবার কথা ভাবতেই পারেন না। কবরগুলোর প্রতি তাঁর ভীষণরকম মায়া জমে গেছে। দিনে দিনে সেই মায়া কেবল বাড়ছেই।
কথায় কথায় তিনি তাঁর পালক মকবুল চাচার প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আনেন। বললেন, 'আমার নামটা মকবুল চাচাই রাখছিলেন। বাচ্চাশিশুর মুখে তো আর ধর্মের পরিচয় থাকার কথা না, মকবুল চাচাও জানতেন না, আমি কোন ধর্মের। অনেক ভেবে তিনি আমার নাম রাখলেন হেদায়েত। বুদ্ধি হওয়ার পর কালেমা শিখাইছেন, দোয়া দরুদ পড়াইতেন নিয়মিত। মকবুল চাচা বেঁচে নাই অনেকদিন, দুই বৎসর আগে তাঁর মৃত্যু হয়। এখন আমার চারপাশের এই কবরগুলো ছাড়া আর কেউ নাই, আমার নিজের বলতে।'
তাঁর প্রথম কবর খোদাইয়ের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে, বললেন, 'প্রথম কবর খোদাই করছি এক বয়স্ক মহিলার। কীভাবে কবর খোদাই করতে হয়, তা মকবুল চাচার কাছ থেকে আগে শিখে নিছিলাম। মকবুল চাচা বলছিলেন, কবর দুই রকমের হয়; সিন্ধুকী কবর আর বগলী কবর। আরব দেশের মাটি শক্ত বলে সেখানে বগলী কবর খোদাই করতে হয়। বাংলাদেশের মাটি নরম, তাই এখানে সিন্ধুকী কবর খোদাই করাই নিয়ম।
'মকবুল চাচার শিখানো নিয়ম মতে লাশের কিছু উপরে আড়াআড়িভাবে বাঁশ দিয়ে তার উপর চাটাই বিছিয়ে দিলাম। তারপর মৃতের আত্মীয়স্বজন টুকরোটুকরো মাটি ছড়িয়েছিটিয়ে দেওয়া শেষে, বাকি সব মাটি দিয়ে কবর ঢেকে দিলাম আমি। মাটি দিয়ে ঢাকবার আগে মকবুল চাচার নির্দেশ মনে রাখলাম, কাফনের কাপড় মাথার কাছে, পায়ের কাছে এবং পেট বরাবার লাগানো ফিতায় দেয়া গেরোগুলো খুলে দিলাম। মাটি দিতে গিয়ে কোনো অবস্থাতেই যেন মৃতের গায়ে মাটি না পড়ে, তাও খেয়াল রাখতে হলো।'
হেদায়েত বলতে লাগলেন, 'এরপর থেকে এই পর্যন্ত কতো হাজার হাজার কবর দিলাম, কিন্তু প্রথমটার কথা এখনো ভুলি নাই।'
বললাম, প্রতিদিন এখানে ঠিক কতো সংখ্যক লাশ দাফন করা হয়?
হেদায়েতের উত্তর: 'ঠিক নাই। প্রত্যেকদিন ৩০-৪০টার মতো নতুন কবর হয়।'
এখানে কবর দিতে খরচ কেমন জানতে চাইলাম।
হেদায়েত জানালেন, 'এই ধরেন সব মিলে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো। আগে এখানে কবরের জায়গা বেচাবিক্রি হতো, এখান হয় না। যাদের কবরের জায়গা কেনা আছে, এক কবরের জায়গাতেই একই পরিবারের অনেককেই কবর দিতেও দেখছি।'
বললাম, এখানে তো অনেক পুরোনো কবরও আছে দেখলাম।
হেদায়েত বললেন, 'হ্যাঁ। মকবুল চাচার কাছে শুনছি, এই কবরস্থান প্রায় ৩০০ বছর আগের। ৩০০ বছর আগের কবরও এখানে আছে।'
এক ঘন্টার মতো হেদায়েতের সাথে কথা বললাম। হেদায়েতের প্রতি আমার এই উৎসুক্য এক পর্যায়ে তাঁকেও আমার প্রতি হয়তো কিছুটা উৎসাহী করে তুললো, বললেন, 'এখানে কেউ এসে আমাদের সাথে এমন কথাটথা বলেন না। আপনি একের পর এক বলেই যাচ্ছেন। আপনি কে? কী করেন?'
আমি এক মুহূর্তও না ভেবে বললাম, আমি একজন লেখক। মানুষের জীবন নিয়ে লিখি।
'আমাকে নিয়েও কি কিছু লিখবেন?' হেদায়েত জানতে চাইলেন। বললাম, হ্যাঁ লেখার ইচ্ছে আছে।
হেদায়েত বললেন, 'আমি তো তেমন পড়ালেখা জানি না। যদি লেখেন, তাহলে আমাকে পড়ে শুনাবেন।' বলেই তিনি তাঁর মোবাইল নাম্বারটা আমাকে দিলেন। আমিও আমার নাম্বার হেদায়েতকে দিলাম।
দুই দিন না যেতেই হেদায়েতের ফোন। কুশল জানা শেষে গল্প লিখেছি কিনা জানার প্রবল আগ্রহ। বললাম, একটি লেখা লিখতে একজন লেখককে অনেক গভীর যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়; অনেক অনেক ভাঙাগড়া। হেদায়েত বুঝবেন না, তবু তাঁকে বললাম, যে লেখা নিজের হৃদয়ের যতো গভীর থেকে উঠে আসে, অন্য হৃদয়ের ততো গভীরেই তা গিয়ে পৌঁছায়। আপনার জীবনের গল্প আমার হৃদয়ে বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমশ। এখন শুধু লিখতে বসার অপেক্ষা।
ফোনের এপাশ থেকে আমি আরও বললাম, গল্পের কাহিনী একরকম সাজানো শেষ। আমার এই কথায় হেদায়েত হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। আমি জানি, হেদায়েত কাঁদছেন। যে মানুষ মৃতদেহের কবর খোদাই করেন, দাফন করান__বাচ্চাশিশুর মতো কান্না তাঁকে মানায় না! কী এক আশ্চর্য ক্ষমতাবলে হেদায়েত তাঁর সে কান্না আড়াল করে নিলেন!
👌👌👌👌
ReplyDelete