রুপান্তর

আমি আপনার ফুফাতো ভাইয়ের শালার বউয়ের মামাতো ভাইয়ের...' প্রথমবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর এমন কিছু আত্মীয়স্বজনের দেখা মিলে, যাদের সাথে সম্পর্ক নির্ণয় করতে রীতিমত কাগজ কলম নিয়ে অংক কষতে বসতে হয়। এই 'অত্যাচার' দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হওয়ার পরও এখনো পর্যন্ত থেমে নেই।
সেদিন এক যুবক এলো, এমন ধরণেরই 'আত্মীয়' আমার। অনেকটা অংক কষে নির্ণয় করার মতোই ব্যাপার। পরিচয়পর্ব দিতে গিয়ে থামিয়ে দিলাম তাকে। বললাম, এই পৃথিবীর সব মানুষই কোনো না কোনোভাবে পরস্পরের আত্মীয়।
আমার কাছে আসার কারণটা জানতে চাইলাম। গায়ের রঙ কালো, চেহারাও তেমন সুশ্রী কিছু নয়। কিন্তু পোশাকআশাক ও কথাবার্তায় এক ধরণের আভিজাত্য আছে। সে বললো, 'আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে, বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছি। আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে বিয়েতে।'
বললাম, 'চেষ্টা করবো যেতে।'
দাওয়াত দেওয়ার পর্ব শেষেও যুবকটি বসে রইলো। জিজ্ঞেস করলাম, আরো কিছু বলার আছে কিনা তার। সে কিছুটা ইতস্তত। কথা বললো ভিন্নপ্রসঙ্গে, 'আপনার লেখালেখির নেশার কথা আমার জানা। আপনার লেখা একটি বইও পড়েছি আগে। ফেসবুকে আপনার লেখা নিয়মিত পড়ি। ফেসবুকে আপনার ফলোয়ার আমি। খুব ভালো লিখেন আপনি।'
ধন্যবাদ জাতীয় কিছু একটা বলা দরকার। তবু বললাম না। কিছুক্ষণ নিরব থেকে সে বললো, 'আমার নিজের কিছু কথা আপনাকে বলতে চাইছি, আপনার কোনো লেখায় যদি তা কাজে আসে। অনুমতি দিলে বলি...'
অনুমতি দিলাম। সে বলা আরম্ভ করলো__'আমার এক প্রতিবেশি, অসম্ভব এক সুন্দরী। বেশি বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। এই মুহূর্তে আপনি যা ভাবছেন ঘটেছেও তাই__আমি মেয়েটির প্রেমে পড়ে যাই। দেখতে আমি সুন্দর নই বলে সে আমাকে পাত্তা দিতো না, এড়িয়ে যেতো। বলা যায় অবহেলাই করতো আমাকে। একদিন তো রীতিমত অপমান করে বলেই বসলো, 'আয়নায় নিজের চেহারাটা কখনো দেখেছেন?' সে কিছুটা অহংকারীও।'
বললাম, 'সুন্দরী মাত্রই অহংকারী হয়। অহংকারও সুন্দরিদের সৌন্দর্যেরই অলংকার।'
সে আবার বলতে শুরু করলো, 'এক ফাঁকে মেয়েটির নামটাও জানিয়ে রাখি, ওর নাম 'নিশু'। নিশু আমাকে এড়িয়ে চলে, তবু আমি দমে যাবার পাত্র নই। তাকে এসএমএস করি নিয়মিত, ফোন দিই, দেখতেও যাই। কিন্তু তার মনের নাগাল পাওয়া যায় না কিছুতেই।
মাস তিনেক আগে মারাত্মক এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয় নিশু। মুখের, ঠোঁটের অনেকটা অংশে জটিল ধরণের অপারেশন করতে হয়। এক পায়ের পাঁচটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়। অপারেশনের পর মুখের দিকে তাকানোই যায় না, চেহারাটা এক ধরণের ভৌতিক অবস্থায় পরিণত হয়।'
বললাম, 'তারপর...'
তার ঠোঁটের রেখায় রহস্যময় হাসি। বললো, 'আপনি তো লেখক মানুষ, অসম্ভব কল্পনাশক্তি থাকে আপনাদের। বাকিটা আপনার কল্পনা দিয়েই ভরিয়ে দেবেন। কল্পনার মতো দামি ঐশ্বর্য আর যে কিছুই নেই, তা আপনারা লেখকরাই ভালো জানার কথা।'
ছেলেটি যাওয়ার জন্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বললো, 'যাই। বিয়েতে অবশ্যই আসবেন।' তারপর সে যা বললো, তা শুনে আমার বিস্ময়ের অন্ত রইলো না, বললো, 'নিশু মেয়েটার সাথেই বিয়েটা হচ্ছে আমার।'
আমি পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মানুষের কোনো চাওয়াই অপূর্ণ থাকে না, কোনো না কোনো ভাবে তা পূরণ হয়ে যায়ই একদিন। সে চাওয়া যদি মন থেকে হয়, নিখাদ হয়।
মনে মনে বললাম, পৃথিবীর সমস্ত সুখ এই যুগল নরনারীকে ঘিরে থাকুক অনুক্ষণ। সুখি হোক তারা।



Comments